উগ্রপন্থা ও মবের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনমত

ছায়ানটের প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষ একাত্মতা জানান। মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনের সামনেছবি: প্রথম আলো

মানুষের মনের ভেতর যে দম বন্ধ হয়ে আসা অস্বস্তি প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে চাপা পড়েছিল, সেটা যেন হঠাৎ করেই প্রকাশ পাওয়ার পথ পেয়ে গেল। ক্ষোভগুলোও যেন উগরে দেওয়ার একটা পথ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল। ফলে অনেকটাই ভয়হীন, দ্বিধাহীনভাবে মানুষ তাদের মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদীচী অফিসে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদের রাস্তাটা যেন হঠাৎ খুলে দিল।

এর আগে বছরজুড়েই তো দেশের বিভিন্ন স্থানে মব হয়েছে, সন্ত্রাস হয়েছে, মানুষ হতাশ হয়েছে, আতঙ্কিত হয়েছে, ক্ষুব্ধও হয়েছে; কিন্তু সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি। এভাবে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদও গড়ে ওঠেনি। অথচ যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজেই যেকোনো অসংগতি নিয়ে প্রতিবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ–বিক্ষোভ স্বাভাবিক ঘটনা। সেই স্বাভাবিকতাটাই যেন হারিয়ে বসেছি আমরা।

ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার কর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে মেরে গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা, লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে ঘরে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে বাবা–মার সামনেই শিশু আয়েশাকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা কেবল দেশেরই নয়, বিশ্বের বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। দীপু দাসের ঘটনাটি তো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ কেড়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে এত দিন খুব বেশি সরব ছিল না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কিংবা তাঁর প্রতি একধরনের আস্থার কারণেই হয়তো বা তাঁরা ‘দেখি, অপেক্ষা করি’ নীতি বেছে নিতে চাইতেন। এবার যেন তাঁদের সেই ‘দেখার, অপেক্ষার’ পালায়ও চিড় ধরেছে।

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটে হামলা চালাতে গিয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাত গুটিয়ে বসে থেকে নৈরাজ্য ঘটতে দিয়েছে—তার প্রতিবাদে কোনো রাজনৈতিক দল কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। হতে পারে বর্তমানের সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের ক্ষমতার অংশীজন ভাবে, কিংবা তারা অংশীজন বলেই এই নৈরাজ্যের কিংবা নৈরাজ্য দমনে সরকারের নিস্পৃহতার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

ডেইলি স্টার-প্রথম আলো অফিসে হামলাকারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। উদীচী, ছায়ানট অফিসে হামলাকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হোক। হামলাকারীদের অসংখ্য ভিডিও, স্টিল ছবি আছে, কাজেই তাদের খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই সঙ্গে এই উন্মত্ততা তৈরির নেপথ্য কুশীলবদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

দেশের প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বিএনপি অন্তত কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারত। তারা সেটা করে উঠতে পারেনি। তবে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), সম্পাদক পরিষদ প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে নাজেহাল করার প্রতিবাদে সভা করে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেই সভায় বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধি যাঁরাই বক্তৃতা করেছেন, প্রায় সবাই সরাসরি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন, সরকারের নিস্পৃহতায় তাঁদের হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তো সরকারের বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন। সম্পাদক পরিষদের নতুন সভাপতি, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর সরাসরি অভিযোগ করেছেন পুরো সরকার অথবা সরকারের একাংশ এ ঘটনা ঘটতে দিয়েছে। তিনি সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা, দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সাহায্য চেয়েছিলেন। সাহায্য না পেয়ে তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেছেন বলে বিভিন্ন বক্তৃতায় জানিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, নোয়াব এবং সম্পাদক পরিষদের কঠোর প্রতিক্রিয়াই আসলে মানুষের মনের বদ্ধ আগলটা ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেছে। ছায়ানটের ‘গানে গানে সংহতি সমাবেশ’ মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আরও পড়ুন

নোয়াব এবং সম্পাদক পরিষদের সভার বক্তব্য এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নূরুল কবীরের বক্তব্য বাংলাদেশে উগ্রপন্থীদের উত্থান এবং রাজনীতি তথা সরকারে তাদের প্রভাবের বিষয়টি পশ্চিমাদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়। নূরুল কবীর স্পষ্টভাবেই বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাটি উগ্র ডানপন্থীদের কাজ বলে তাঁর মনে হয়েছে এবং সরকার ঘটনাটি ঘটতে দিয়েছে। ফলে সরকার এবং উগ্র ডানপন্থীদের সম্পর্কের বিষয়টি বিদেশিদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

এবং এই প্রথম বিদেশি কূটনীতিক, মানবাধিকার সংস্থা, অন্যান্য সংগঠন একযোগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের তৎপরতা বৃদ্ধি নিয়ে নিশ্চিত হয়।

পাশাপাশি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি হত্যায় কারা জড়িত, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আর একেবারে শুরু থেকেই ‘এই হত্যাকাণ্ডটি যে অস্থিরতা তৈরি করে নির্বাচন ভন্ডুল করার তৎপরতার অংশ’—এমন একটা আলাপ মানুষের মধ্যে ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্যের পর অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আসলে কারা সেই আলোচনা–পর্যালোচনা সামনে চলে আসে। এখন তো শহীদ হাদির ভাইয়ের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে যারা নির্বাচন চায় না তারাই হাদিকে হত্যা করেছে।

ডেইলি স্টার-প্রথম আলো অফিসে হামলাকারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। উদীচী, ছায়ানট অফিসে হামলাকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হোক। হামলাকারীদের অসংখ্য ভিডিও, স্টিল ছবি আছে, কাজেই তাদের খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই সঙ্গে এই উন্মত্ততা তৈরির নেপথ্য কুশীলবদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির স্বার্থেই এই দুষ্কৃতকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। একই সঙ্গে সব ধরনের মব, উগ্রপন্থা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধের উদ্যোগ চলমান রাখতে হবে।

  • শওগাত আলী সাগর টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক

    *মতামত লেখকের নিজস্ব