মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতের অভূতপূর্ব সম্পর্কের রহস্য কী

মোদি ২০১৫ সাল থেকে সাতবার আরব আমিরাত সফরে এসেছেন, যেখানে ১৯৮১ সালের পর কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফরেই যাননি।ছবি: এএফপি

ভারত যে ভূরাজনীতিতে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। নরেন্দ্র মোদি তাঁর মধ্যপ্রাচ্য সফরে প্রথমেই গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

দেশটির সঙ্গে তিনি একটি বিনিয়োগ চুক্তি করেছেন। পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন প্রায় ৪০ হাজার ভারতীয় অভিবাসীকে নিয়ে সমাবেশ এবং হিন্দুদের বিরাট একটি মন্দির উদ্বোধন করে।

এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী পাশের দেশ কাতারে যান। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সদ্যই কারাবন্দী আট ভারতীয় নাগরিকের মুক্তি নিশ্চিত করেছেন তিনি। এদিকে কাছেই কাতার জলসীমায় ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ অবস্থান করছে। জলদস্যু ও হুতিদের মিসাইল হুমকি থেকে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে সেগুলো।      

ফেব্রুয়ারি ১৩ তে শুরু হওয়া মোদির এই মধ্যপ্রাচ্য সফরে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন ব্যবসা, অভিবাসন ও নিরাপত্তা। আমরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ভারতের যে মনোভাব ছিল তাতে বড় পরিবর্তন ঘটতে দেখছি। এক দশক আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের কূটনৈতিক উদ্যোগে নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছেন মোদি।

ইরানের সঙ্গ ত্যাগ করে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের এই উদ্যোগ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।    

ভারতের এই অবস্থানগত পরিবর্তন সব পক্ষের জন্যই লাভজনক। বিশেষ করে ভারতের বৈদেশিক বিনিয়োগ এ থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। এই অঞ্চলে অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতে চীনের প্রধান প্রতিযোগী হয়ে ওঠার সুযোগ এখন ভারতের।

মধ্যপ্রাচ্যকে স্থিতিশীল করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় অঞ্চলের অংশীদারদের যে চেষ্টা, তাতে ভারতের অবস্থান আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। কিন্তু এতে ঝুঁকিও আছে। গাজায় সহিংসতা ও এর রেশ লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃতির কারণে ভারতের বিনিয়োগ, প্রবাসী ভারতীয়, তাদের জাহাজ ও পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।

মোদির এই সফরের পেছনে ঘরোয়া রাজনীতির একটি দিক আছে। আগামী মে-তে ভারতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রবাসী ভারতীয়দের আবুধাবিতে একত্র করার উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বে অবস্থানরত ভারতীয়দের সমর্থন আদায়। তা ছাড়া অভিবাসী ভারতীয়রা রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলের অন্যতম প্রধান দাতা।

আরও পড়ুন

১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া মসজিদের স্থলে সম্প্রতি মন্দির স্থাপন করেছেন মোদি। এর এক মাসের কম সময়ের মধ্যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে মন্দির স্থাপন করে ভারতীয় জনতা পার্টির যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভিত, সেটাকে আরও শক্তিশালী করে তুললেন।  

মোদি তাঁর এই ভ্রমণে মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য দেশে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা হলো, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভারত দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতীয় অভিবাসীরা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাঁর এই সফরের প্রভাব ভালোভাবে অনুভূত হচ্ছে। মোদি ২০১৫ সাল থেকে সাতবার এই দেশটিতে সফরে এসেছেন, যেখানে ১৯৮১ সালের পর কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফরেই যাননি।

৪৩ বছর বয়সী ভারতীয় এক ব্যাংক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ রায় সমাবেশে বলেন, ভারতীয়দের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান অনেক বেড়েছে। আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি রাস্তায় হাঁটতে গিয়েও এটা বুঝতে পারি।

মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ শত বছরের পুরোনো। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর এই সম্পর্ক ক্রমেই থিতিয়ে আসে। কারণ, পাকিস্তানের প্রতি আরব বিশ্বের সমর্থন। আবার এদিকে ভারতের সঙ্গে ইরানের বন্ধন এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি একাত্মতার কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে ভাটা পড়েছিল। এখন মোদি চাইছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে।  

ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রের দিকে যদি তাকাই, এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বলতে অতীতে ছিল শুধু তেল আমদানি ও সস্তা শ্রমশক্তির রপ্তানি। গত কয়েক বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। এখন আমিরাতের রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হলো ভারত।

গত বছর দুই দেশ তেল ছাড়া অন্যান্য পণ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। এই চুক্তির আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ব্যাপারে দেশ দুটি একমত হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ ভারতে আনার উদ্যোগও এগিয়ে চলছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতে আমিরাতের বিনিয়োগ ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এর আগের পাঁচ বছরের তুলনায় এই বিনিয়োগ প্রায় তিন গুণ। আমিরাতের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ভারতে অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। সৌদি আরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের।

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে মধ্যপ্রাচ্য এখন সে দেশের অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগে চীনের বিকল্প খুঁজছে। বড় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুযোগ নিচ্ছেও। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে লারসেন অ্যান্ড টুব্রো। তাদের ৫৫ বিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশের ৩০ শতাংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে।

মোদি আমিরাত সফরে গিয়ে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তাতে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়। দেশ দুটি শুধু দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি করেনি, তাদের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবস্থা চালু করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে মধ্যপ্রাচ্যকে মাঝখানে রেখে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যপথ চালুর ব্যাপারেও দেশগুলো এখন একমত।

যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটছে, ফলে অভিবাসী ভারতীয়র সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমাগত। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত দেশ বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এখন ভারতীয়দের সংখ্যা ৯০ লাখ। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭০ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ, অর্থাৎ সাড়ে ৩০ লাখ থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

প্রবাসী ভারতীয়দের বড় অংশই অবশ্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সম্পদশালী ও মধ্যবিত্তরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে থিতু হয়েছেন, বিশেষ করে দুবাইতে। ভারতে কোভিড-১৯-এ বহু মানুষের মৃত্যুর পর অনেকেই দেশ ছাড়েন।

অনেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘গোল্ডেন ভিসা’র সুযোগ নিয়েছেন। ২০১৯ সালে যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের দেশটি ২০ বছরের জন্য আবাসন সুবিধা দিচ্ছে।  

আমিরাত অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সে কারণেই ২০১৫ সালে মোদি যে হিন্দু মন্দির স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ এই মন্দিরের জন্য ২৭ একর জমি দিয়েছেন।

আমিরাত অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। সে কারণেই ২০১৫ সালে মোদি যে হিন্দু মন্দির স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ এই মন্দিরের জন্য ২৭ একর জমি দিয়েছেন। আবুধাবির সমাবেশে মোদি শেখ মুহাম্মদকে তাঁর ভাই বলে সম্বোধন করেন।

আবুধাবির সমাবেশে মোদি শেখ মুহাম্মদকে তাঁর ভাই বলে সম্বোধন করেন।

ভারতীয়দের খাতির-যত্নে রাখার জন্য ধন্যবাদও জ্ঞাপন করেন। মোদি বলেন, আমরা পারস্পরিক অগ্রগতির পথে সহযাত্রী। মেধা, আবিষ্কার ও সংস্কৃতির বিনিময় এই সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।  

নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই অঞ্চলের চেহারা বদলে যাচ্ছে কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে। ভারতকে অস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোর প্রথম তিনটির একটি হলো ইসরায়েল। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ভারত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অন্যতম অংশীদার।

এখন ভারত এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমা সুরক্ষায় কাজ করছে। নৌবাহিনীর এত বড় টহল আর কখনো ভারতের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশদের সঙ্গে লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতিদের নিশানা করে হামলায় ভারত যুক্ত হয়নি। তবে তারা লোহিত সাগরে জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করায় কাজ করে চলেছে।

তারা প্রায় ২৫০টি জাহাজ পরিদর্শন করেছে, এর মধ্যে ৪০টিতে নিজেরা উপস্থিত থেকে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও জাহাজের নাবিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ভারত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে সমন্বয় করে চলছে।  

মোদি তাঁর এই নতুন কৌশল বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের যে ঐতিহাসিক অবস্থান, সেখান থেকে সরে এসে মোদি ইসরায়েলের প্রতি তাঁর জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন।

তবে এর কয়েক দিন পরই সরকারের তরফ থেকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে ভারতের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে ইসরায়েলের তীব্র সমালোচনা করে আসছে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক দক্ষিণে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রত চীনও।

উপসাগরীয় দেশগুলো যদি গাজা ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করে, তাহলে ভারতকেও তার কৌশলে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।  

গত অক্টোবরে কাতারের আদালত ভারতের সাবেক আট নৌ কর্মকর্তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিলে তাতে ভারত যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে। ভারত কোন প্রক্রিয়ায় তাদের ছাড়িয়ে এনেছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে গেল সপ্তাহে ভারত কাতার থেকে ২০৪৮ সাল পর্যন্ত ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গ্যাস কেনার চুক্তি করেছে। ভবিষ্যতেও নানামুখী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ভারতের আগ্রহ যত বাড়ছে, ঝুঁকিও বেড়েছে ততটাই।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক সি রাজা মোহন বলেন, ভারত এখন যে খেলা খেলছে, তাতে আঘাত আসবে, কখনো ধাক্কা খেয়ে সরে যেতে হবে, আবার কখনো ধাক্কা দিতেও হবে। বিশ্ব মোড়লদের ক্লাবে ঢুকতে হলে এই চক্করে পড়তেই হবে।  

দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম