ইউক্রেনকে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না

ইউক্রেন থেকে রাশিয়া এ মুহূর্তে পিছিয়ে আসার অবস্থায় নেই। রাশিয়ার ইতিহাস দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইতিহাস
রয়টার্স

এক বছর পার হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, যুদ্ধটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড দখলের মতো ৩৫ দিনের মধ্যে শেষ হবে। নাৎসি জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্লোভাকরা যুদ্ধ করলেও এটিকে হিটলারের চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসনমূলক যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিটসুলা নদীর পূর্ব তীরে রয়ে যাওয়ার কারণে নাৎসি জার্মানি ওয়ারশসহ পোল্যান্ডের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে। এখান থেকেই সর্বাত্মকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

এ যুদ্ধ ইউরেশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউরোপ। এ যুদ্ধে ইউরোপের বড় দেশগুলোর শক্তিসামর্থ্য মাটিতে মিশে যায়। ওই সময়কার ক্ষয়িষ্ণু পরাশক্তি ব্রিটেনের হাত থেকে উপনিবেশগুলো যেমন হাতছাড়া হয়ে যায়, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও দেশটি একপ্রকার দেউলিয়া হয়ে যায়। বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কথিত পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত প্রভাববলয়ে এবং পশ্চিম ইউরোপ ওই যুদ্ধের কারণে নতুন সুপার পাওয়ার মার্কিন বলয়ে চলে যায়। এ যুদ্ধে পুরো ইউরোপ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, যার ত্রাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইকোনমিক রিকভারি অ্যাক্ট অব ১৯৪৮’ (যাকে আমরা মার্শাল প্ল্যান হিসেবে জানি) আবির্ভূত হয়। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠে।

ওই যুদ্ধের শেষের দিকে হিটলারের হঠকারিতার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে সম্পূর্ণ পোল্যান্ড, জার্মানির অর্ধেক ও পূর্ব ইউরোপ দখল করে নেয়। সমাজতান্ত্রিক বলয় তৈরির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে।

সোভিয়েতে সমাজবাদী দর্শনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী তত্ত্বের বিপরীত ধারা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে কথিত সোভিয়েত আগ্রাসন রুখতে সক্রিয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ১২টি দেশ নিয়ে তৈরি হয় সামরিক জোট ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন), যা আজও বলবৎ এবং আগের চেয়ে এর সদস্যসংখ্যা বাড়ছে। এ ন্যাটোকে ঠেকাতে ১৯৫৫ সালে মূলত পূর্ব ইউরোপের সাতটি দেশ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সৃষ্টি হয় আরেক সামরিক জোট ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’ বা ওয়ারশ চুক্তি।

এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে এবং ওয়ারশ চুক্তি বিলুপ্ত হয়েছে; কিন্তু ন্যাটো সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। এতে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জার্মানি-ফ্রান্স তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্ব দৃঢ় হতে থাকে।

ন্যাটোর কার্যকারিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় কথা উঠলেও দেশটির দুটি দলই ন্যাটোকে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। ২০ বছর আফগান যুদ্ধে জড়িত থাকার পর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ন্যাটো নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে ন্যাটো জোট রাশিয়ার সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ নেয়।

সংক্ষিপ্তভাবে ওপরের আলোচনায় ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এবং পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের সঙ্গে ম্যাকেন্ডারের ‘হার্টল্যান্ড তত্ত্ব’ তুলে ধরেছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার ধারণা, এ যুদ্ধ সহজে সমাপ্ত হওয়ার নয়। সরাসরি না হলেও যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বজায় রাখতে যা করার তা-ই করছে এবং সম্ভবত করে যাবে। অন্যদিকে, রাশিয়া এ মুহূর্তে পিছিয়ে আসার অবস্থায় নেই।

ট্রাম্প ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা ছিল তাঁরই দেশের দুই ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ড. হেনরি কিসিঞ্জার ও ড. জিবিগনিউ ব্রেজেজিনিস্কি তত্ত্বের বিপরীত। স্যার হেলফোর্ড ম্যাকেন্ডারের ‘হার্টল্যান্ড’ তত্ত্ব সমর্থন করে এ দুই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান পুনর্জাগরণকে ঠেকাতে হলে সাবেক পূর্ব ইউরোপ এবং বিশেষ করে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কিছুতেই খর্ব করা যাবে না।

সে তত্ত্ব অনুযায়ী সোভিয়েত সীমান্তবর্তী তৎকালীন ওয়ারশ চুক্তির দেশগুলোকে ন্যাটোভুক্ত করা হয়েছিল। এতে রাশিয়া নিরাপত্তা ও কৌশলগত পশ্চাদপসরণের শঙ্কায় ভুগতে থাকে। বর্তমানে সাবেক সোভিয়েত বলয়ের (ইউক্রেন বাদে) দেশগুলো নিয়ে মোট সদস্যসংখ্যা ৩০।

আরও পড়ুন

স্মরণযোগ্য যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র স্যার হেলফোর্ড ম্যাকেন্ডার অনুসৃত হার্টল্যান্ডের তত্ত্বের আদলে ভূরাজনৈতিক নীতি ও সামরিক কৌশল অনুসরণ করছে।

ম্যাকেন্ডার ১৯০৪ সালে তাঁর গবেষণামূলক লেখা দ্য জিওগ্রাফিক্যাল পিভট অব হিস্ট্রি বইয়ে এ তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে ইউরেশিয়া (যার দ্বার-পথ পূর্ব ইউরোপ; বিশেষ করে ইউক্রেনের সমতট) যার দখলে থাকবে, সে পৃথিবী পরিচালিত করবে। তিনি এ জায়গাকে বলেছিলেন হার্টল্যান্ড বা মধ্যাঞ্চল। সেই থেকে এ তত্ত্ব হার্টল্যান্ড তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। হিটলার এ তত্ত্বকে ধারণ করেছিলেন এবং হার্টল্যান্ড দখল করতে ইউক্রেনের পথেই রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ন্যাটো-ওয়ারশ জোট মুখোমুখি ছিল প্রায় ৪৬ বছর। বিশ্ব শীতল যুদ্ধের মধ্যে ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙন এবং পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েত বলয় থেকে বের হওয়ায় ওয়ারশ চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। ইউরোপের সঙ্গে নতুন রাশিয়ার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

হার্টল্যান্ড তত্ত্বের সমর্থনে জিবিগনিউ ব্রেজেজিনিস্কি তাঁর রচিত দ্য গ্র্যান্ড চেসবোর্ড: আমেরিকান প্রাইমেসি অ্যান্ড ইটস জিওস্ট্র্যাটেজিক ইমপ্যারেটিভস বইয়ে বলেন, ইউক্রেন ইউরেশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক স্থান। তিনি একবিংশ শতাব্দীতে হার্টল্যান্ড তত্ত্বের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দেন, ইউরোপ, তথা সমগ্র বিশ্বে প্রভাব বজায় রাখতে হলে শুধু ইউক্রেনকে হাতে রাখলেই হবে না; রাশিয়া ও বিপরীত শক্তির উত্থানকে খর্ব করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে আজারবাইজান, উজবেকিস্তানসহ হার্টল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে রাখতেই হবে।

এ তত্ত্বে ইউক্রেন হার্টল্যান্ডের সদর দরজা। তাই যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি না হলেও ইউরোপে তার উপস্থিতি দৃঢ় করতে ইউক্রেনকে কোনোভাবেই রাশিয়ার বলয়ে যেতে দেবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ন্যাটো সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাশিয়াকে এ যুদ্ধে জড়াতে প্ররোচিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন রাশিয়ার প্রবেশদ্বার বলে রাশিয়া কোনোভাবেই ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ মানতে পারেনি। পুতিন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এ অঞ্চলে এককভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে দিলে ‘ইউরেশিয়া’ যেমন হাতছাড়া হবে, তেমনি পৃথিবী এক বলয়ে থেকে যাবে। এ প্রেক্ষাপটেই চীন-রাশিয়া এবং ভারতের অক্ষ তৈরির চেষ্টা চলছে।

সংক্ষিপ্তভাবে ওপরের আলোচনায় ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এবং পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের সঙ্গে ম্যাকেন্ডারের ‘হার্টল্যান্ড তত্ত্ব’ তুলে ধরেছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমার ধারণা, এ যুদ্ধ সহজে সমাপ্ত হওয়ার নয়। সরাসরি না হলেও যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বজায় রাখতে যা করার তা-ই করছে এবং সম্ভবত করে যাবে। অন্যদিকে, রাশিয়া এ মুহূর্তে পিছিয়ে আসার অবস্থায় নেই।

রাশিয়ার ইতিহাস দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইতিহাস। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যেহেতু রাশিয়া আক্রমণ করে সুবিধা করতে পারেনি, তাই ম্যাকেন্ডার, ব্রেজেজিনিস্কি ও কিসিঞ্জার যাকে ‘হার্টল্যান্ড’ এর প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করেন, সেই ইউক্রেনের যুদ্ধ সহজে থামবে বলে মনে হয় না। 

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

  • [email protected]