‘প্যাক্স আমেরিকানা’ শেষ, গণতন্ত্রের নতুন নেতা কে

ইউরোপীয় নেতারা জরুরি বৈঠক করেছেন, অনেক সাহসী বক্তব্য দিয়েছেনছবি: রয়টার্স

‘প্যাক্স আমেরিকানা’ নামে পরিচিত আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা এখন শেষের দিকে। অতীতে অনেক বামপন্থী ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বব্যবস্থাকে আজকের এই অবস্থানে আনার স্বপ্ন দেখতেন; কিন্তু বাস্তবে ডানপন্থী উগ্রবাদীরাই শেষ পর্যন্ত ‘প্যাক্স আমেরিকানা’র ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে।

আসলে আমেরিকার কট্টর ডানপন্থীরা বরাবরই উদারপন্থী শাসকদের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার যে প্রধান মিত্রদেশগুলো নির্ভরশীল ছিল, তারা এ অবস্থায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

ইউরোপীয় নেতারা বেশ কয়েকটি জরুরি বৈঠক করেছেন। সেখানে তাঁরা অনেক সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিনিধি কায়া কালাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘মুক্ত বিশ্বের নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন’ এবং ‘এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের, ইউরোপীয়দের’।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার একে ‘প্রত্যেক প্রজন্মে একবার আসা সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করে ইউক্রেনে একটি ন্যায্য যুদ্ধবিরতি অর্জন করার লক্ষ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কারণ, যুক্তরাজ্য ছাড়া ফ্রান্সই ইউরোপের একমাত্র দেশ, যার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র আছে।

তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল জার্মানির সম্ভাব্য পরবর্তী চ্যান্সেলর ফ্রিড‌রিখ মের্ৎসের বক্তব্য। তিনি আগে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, ইউরোপকে ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে’।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন; ইউক্রেনকে অপমান করেছেন; ডানপন্থী চরমপন্থাকে উৎসাহিত করেছেন এবং আগ্রাসী স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়েছেন। এর ফলে ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে নতুন প্রতিরক্ষা জোট গঠনে উদ্যোগী হবে—এটা এখন আশা করা যেতে পারে।

ট্রাম্প যেসব কাণ্ড করছেন এবং তার ফলে বৈশ্বিক শৃঙ্খলায় যে পরিবর্তন আসছে, তাতে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে সেই নতুন বিশ্বব্যবস্থা বাস্তবায়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিজে কোনো সামরিক শক্তি নয়; আর যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে কোনো সামরিক জোট গড়া হলে তা যে আমেরিকার দেওয়া বিদ্যমান নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অভাব পূরণ করতে পারবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

ন্যাটোর বিকল্প হিসেবে যদি ইউরোপীয় দেশগুলো একসঙ্গে একটি সামরিক জোট গঠন করতে চায়ও, তা বাস্তবায়ন করতে অনেক বছর লেগে যাবে। আর এই উদ্যোগ সফল হতে হলে অবশ্যই জার্মানির নেতৃত্ব প্রয়োজন; কারণ, জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি।

২০১১ সালে পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাডেক সিকোরস্কি বার্লিনে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি জার্মান শক্তির চেয়ে জার্মান নিষ্ক্রিয়তাকে বেশি ভয় পাই।’

যেসব ইউরোপীয় দেশ একসময় নাৎসি জার্মানির দখলের নির্মম অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল, তাদের অনেকেই হয়তো এ কথার সঙ্গে একমত হবে। তবে এটি হয়তো সব জার্মানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না। কারণ, তাঁরা এখনো সামরিক শক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। অতীতে এই মনোভাব পুরো ইউরোপকে, এমনকি জার্মানির নিজেদেরও বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল।

এ ছাড়া জার্মানির কিছু মানুষ রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। দেশটির সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড’ (এএফডি) দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। এই দল ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ এবং দলটি ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার বিরোধিতা করে।

এর বদলে কী হতে পারে? আমেরিকা যখন মিত্রদের ছেড়ে যাবে, তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে নতুন কোনো পরাশক্তির ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে; ব্রিটেন আমেরিকার সঙ্গে তাদের ‘বিশেষ সম্পর্কের’ ওপর জোর দিতে পারে; জার্মানি অথবা ফ্রান্সও (মারি লো পেন যদি প্রেসিডেন্ট হন) রাশিয়ার সাহায্য চাইতে পারে; জাপান একা পড়ে গিয়ে হিরোশিমার পরমাণু ট্রমা ভুলে গিয়ে নিজেরা পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারে।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো এই অঞ্চলের কোনো মার্কিন মিত্রদেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র নেই। এ ছাড়া ইউরোপের ন্যাটোর মতো কোনো সামরিক জোটও নেই, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে।

মার্কিন নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল দেশ জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী মিত্র। একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়াও মার্কিন নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীল। কারণ, তারা সব সময় পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত উত্তর কোরিয়ার হুমকির মধ্যে থাকে।

এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও মার্কিন সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা চীনের আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চাইছে।

এরপর আসে তাইওয়ানের প্রসঙ্গ, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা চুক্তিই নেই। যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে ত্যাগ করে পুতিনের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির জন্য তাইওয়ানের গণতন্ত্রকেও বলি দিতে পারেন।

যদি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্যাক্স আমেরিকানা বা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা শেষ হয়ে যায়, তাহলে চীন যেন এই অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তার একমাত্র উপায় হবে একটি এশীয় ন্যাটো গঠন করা।

এই জোটে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোর পাশাপাশি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের মতো আধা গণতান্ত্রিক দেশ এবং এমনকি ভিয়েতনামের মতো কিছু স্বৈরাচারী রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

তবে এ ধরনের সংগঠনও ইউরোপীয় জোটের মতো একই সমস্যার মুখোমুখি হবে। এ অঞ্চলে জাপানই একমাত্র দেশ, যা এত বৈচিত্র্যময় একটি জোটকে নেতৃত্ব দিতে পারে। তবে কিনা এশিয়ার অনেক দেশই জাপানের নেতৃত্ব নিয়ে সতর্ক ও সন্দেহপ্রবণ। এর কারণ, দেশটি দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি রক্ষণশীল দলের অধীন পরিচালিত হয়ে আসছে, যে দলের নেতারা অতীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নৃশংস কর্মকাণ্ড চালানোকে পুরোপুরি স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না।

অন্যদিকে অনেক জাপানির মধ্যেও আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। কারণ, তাঁদের দেশ আবার বড় কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত কি না, সে ব্যাপারে তাঁরা নিজেরাই এখনো পরিষ্কার নন। ঠিক একইভাবে অনেক জার্মানও নিজেদের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেন না।

এশিয়া ও ইউরোপে ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ একদিন না একদিন শেষ হবেই।

অনেক ধনী দেশ তাদের নিরাপত্তার পুরো দায়িত্ব একটি সুপারপাওয়ারের (আমেরিকা) ওপর চাপিয়েছে—এমন ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে কখনোই স্বাস্থ্যকর ছিল না। কিন্তু এ ব্যবস্থা ভাঙার সময় এবং পদ্ধতি অত্যন্ত খারাপ হতে চলেছে। ঠিক যখন ইউরোপ ও এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো স্বৈরশাসক জোটের হুমকির মুখে, তখন তাদের রক্ষাকর্তা (আমেরিকা) সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এতে নতুন করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার সময়ও পাওয়া যাবে না।

এর বদলে কী হতে পারে? আমেরিকা যখন মিত্রদের ছেড়ে যাবে, তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে নতুন কোনো পরাশক্তির ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে পারে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে; ব্রিটেন আমেরিকার সঙ্গে তাদের ‘বিশেষ সম্পর্কের’ ওপর জোর দিতে পারে; জার্মানি অথবা ফ্রান্সও (মারি লো পেন যদি প্রেসিডেন্ট হন) রাশিয়ার সাহায্য চাইতে পারে; জাপান একা পড়ে গিয়ে হিরোশিমার পরমাণু ট্রমা ভুলে গিয়ে নিজেরা পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারে।

তবে এগুলো নিশ্চিত কিছু নয়। হয়তো ইউরোপীয়রা ঐক্যবদ্ধ হবে, ট্রাম্পের হুমকি কেবল মুখের কথা থেকে যাবে, হয়তো আমেরিকা এশিয়া ছাড়বে না। কিন্তু এসবের ওপর ভরসা করা ঠিক নয়।

বর্তমানে ইউরোপ ও এশিয়ার বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শেষ প্রতিরোধ। আর গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব এখন মূলত পড়েছে জার্মানি ও জাপানের কাঁধে—যারা একসময় এই স্বাধীনতা ধ্বংস করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল!

ইয়ান বুরুমা আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক ও লেখক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ