শিক্ষাকে কোচিংয়ের ‘চেম্বার’ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফেরাবে কে

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের পরিবারের সদস্যরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের দাবি জানানছবি : প্রথম আলো

মাইলস্টোন কলেজে প্রশিক্ষণের যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ার ঘটনার এক মাস পর আরেক শিশুর মৃত্যুর সংবাদ জানা গেল। তাসমিয়া হকের জীবন থেমে গেল মাত্র ১৫ বছর বয়সে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে এক মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিল শিশুটি। তাসমিয়ার শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে এ পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে ২৮ জনই শিশু।

একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ঘটনার ভয়াবহতার ছবি ও ভিডিও বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। আমাদের জাতীয় জীবনে শোক ও আবেগ যুক্তির চেয়ে বেশি আধিপত্য করে। এই স্রোতের মধে৵ই কেউ কেউ প্রশ্নও তোলেন, রানওয়ের এত পাশে কীভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠা পায়, কেন ঢাকার মতো বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্বের শহরে প্রশিক্ষণ বিমান ওড়াতে হবে—শাহজালাল বিমানবন্দরের মতো এমন ব্যস্ত বিমানবন্দরের রানওয়েতে প্রশিক্ষণ বিমান উড়বে?

১১ আগস্ট মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের নিহত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা একটি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে মাইলস্টোন কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং ব্যবসা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। সমাবেশে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা উম্মে তামিমা আক্তার তাঁর মেয়ের মৃত্যুর জন্য কোচিং ব্যবসাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে আমি কখনো কোচিংয়ে দিতাম না। আমার বাচ্চাটাকে দেড় মাস হয়েছে কোচিংয়ে দিয়েছি। কেন দিয়েছি জানেন? আমার বাচ্চা বাসায় এসে আমাকে প্রতিদিনই বলত, “আম্মু, আমি যদি কোচিং না করি, মিসরা আমাকে আদর করেন না।”’

কোচিংয়ে দেওয়ার পর মেয়ে খুশি ছিল জানিয়ে তামিমা আক্তার বলেন, ‘যখন বাচ্চাটাকে কোচিংয়ে দিলাম, এক সপ্তাহ পর আমার ময়না পাখি, আমারে জড়াইয়া ধইরা বলে, মা মিসরা আমাকে এখন অনেক আদর করে।' মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে নিহত আরেক শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দীন বাপ্পীর বাবা মোহাম্মদ আবু শাহীনও একই অভিযোগ করেছেন।

‘চেম্বার’ থেকে শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে ফেরাতে হলে অন্তত বনিয়াদি শিক্ষাকে ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার দৃষ্টিতে ছেদ টেনে অধিকারের দৃষ্টিতে দেখতে হবে

এই অভিভাবকদের কি কোনো সান্ত্বনা আছে? স্কুল ছুটির পর কোচিং না থাকলে এতগুলো শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়তো দেখতে হতো না। জোর করে কোচিং করানোর যে অভিযোগ অভিভাবকেরা তুলেছেন, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনৈতিক চর্চা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। 

স্কুল–কলেজে জোর করে কোচিং করানোর এই চর্চা নতুন কিংবা অভিনব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পর, ২০১০ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে কয়েক মাসের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটিই আমার প্রথম কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা। একাদশের একঝাঁক প্রাণবন্ত ছেলেমেয়েকে পড়ানোর সেই অভিজ্ঞতা ছিল চ্যালেঞ্জিং; কিন্তু ঠিক আড়াই মাসের মাথায় প্রথম মোহ ভাঙল। আড়াই মাসের পাঠের ওপর একটি পরীক্ষা নেওয়া হলো। নির্দেশনা এল, খাতা কড়া করে দেখতে হবে। প্রশ্নও বেশ কঠিন হলো। ফলে বেশির ভাগ সেকশনে বেশির ভাগ বিষয়ে বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করল। ফলাফল দেওয়ার পর অভিভাবকদের ডাকা হলো। যে যে বিষয়ে তাদের সন্তানেরা ফেল করেছে, সেই সব বিষয়ে কোচিং করতে বলা হলো।

আরও পড়ুন

আমি ছিলাম বাংলার শিক্ষক। আমার চারটি সেকশনেই প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থী কোচিং করতে নিজেদের উদ্যোগেই তালিকা তৈরি করল। প্রতি বিষয়ে কোচিং করতে ৫০০ টাকা দিতে হবে। যতদূর মনে পড়ে, এর ৪০০ টাকা পাবেন শিক্ষক আর ১০০ টাকা পাবে কলেজ। সে সময়ে শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হতো, কোচিংয়ের মাধ্যমে তার কয়েক গুণ অর্থ আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি নীতিগতভাবে এ ধরনের কোচিং ব্যবসার বিরোধী থাকায় শিক্ষকতাকে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।

স্কুলের ভেতরেই হোক বা বাইরে—আমাদের প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাটা কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্লাস ছুটির পর কোচিং বসে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কোচিং করান স্কুলের পাশে। সেটাকে বলা হয় ‘চেম্বার’। ঢাকার এ ধরনের চেম্বারে সপ্তাহে দু-তিন দিন কোচিং করানো হয়। শিক্ষার্থীপ্রতি নেওয়া হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। করোনার আগে যেটা ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাবে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশপড়ুয়া বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর জন্য শুধু কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ার জন্য খরচ হয় মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা। এর সঙ্গে স্কুল-কলেজের বেতন, যাতায়াত, বই-খাতার খরচ যোগ করলে মোট ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যায়।    

আরও পড়ুন

ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২ জানাচ্ছে, মোট শিক্ষা খরচের ৭২ শতাংশ বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে বহন করতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যা সর্বোচ্চ। আর গণসাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩’ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, প্রাথমিক শিক্ষায় (পঞ্চম শ্রেণি) এক শিক্ষার্থীর পরিবারের শিক্ষার গড় বার্ষিক ব্যয় ছিল ২০২২ সালে ১৩ হাজার ৮৮২ টাকা, যা ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ২৫ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৮ হাজার ৬৪৭ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। মাধ্যমিক শিক্ষায় (নবম শ্রেণি) এক শিক্ষার্থীর গড় বার্ষিক খরচ ছিল ২০২২ সালে ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা, যা ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ৫১ শতাংশ বেড়ে প্রায় ২০ হাজার ৭১২ টাকা হয়েছে। এই খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রাইভেট টিউশন বা কোচিং এবং নোট বা গাইড বই-ই মূলত দায়ী বলে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এভাবে শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মানে একটাই— সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে চাকরি, ব্যবসাসহ অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং আর গাইড বইয়ের এই বাণিজ্যকে আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে মিলিয়ে না দেখাটা ভুল হবে। গত কয়েক দশকে অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে; কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্প ছাড়া আর কোনো উৎপাদননির্ভর শিল্প ও ব্যবসা খাত বিকশিত হয়নি। ফলে শিক্ষাকে অবাধ বাণিজ্যের খাত হিসেবে খুলে দিয়েছেন আমাদের নীতিনির্ধারকেরা। প্রথমে উচ্চশিক্ষা, এরপর প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গোটা বনিয়াদি শিক্ষাটা ব্যবসার ক্ষেত্র হয়ে উঠল। এখন শিক্ষাটা শ্রেণিকক্ষের বাইরে চেম্বারের বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। রাজনৈতিক দলমত–নির্বিশেষে এখানে দারুণ ঐকমত্য আছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের আয়ের অন্যতম উৎস কোচিং ব্যবসা। ফলে শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তক, কারিকুলাম সংস্কারের প্রশ্ন এলেই স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে নানা আপত্তি আসে।

‘চেম্বার’ থেকে শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে ফেরাতে হলে অন্তত বনিয়াদি শিক্ষাকে ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার দৃষ্টিতে ছেদ টেনে অধিকারের দৃষ্টিতে দেখতে হবে। শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা দিতে হবে। কারিকুলামে আনতে হবে পরিবর্তন। সবাই এগুলো জানেন; কিন্তু শিক্ষাকে চেম্বার থেকে শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর দায়িত্ব নেবে কে?

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী