মেডিকেলের প্রশ্নপত্র, ইন্টারনেটের গতি ও লাইসেন্স দিয়ে বাঘ শিকার

আগামী ১০ মার্চ মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধ করতে তাঁরা আগের দিন ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করবেন। আর পরীক্ষা হলের আশপাশে ফটোকপিয়ার মেশিন চালু করতে দেবেন না। পুরোনোগুলো বন্ধ রাখবেন, নতুন ফটোকপিয়ার মেশিন বসতে দেবেন না। সূত্র: বিডিনিউজ ২৪।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রণালয় করোনার দিনগুলো থেকে বিখ্যাত। আলোচিত। তিনি সম্ভবত করোনার বিস্তার রোধের পদ্ধতি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধের কৌশল রপ্ত করেছেন। করোনাভাইরাস দেশে ঢুকে পড়েছে। এবার এটার বিস্তার ঠেকাতে হবে। তখন উপায় বের করা হলো, সবাইকে ঘরে আটকে ফেলা। লকডাউন। কেউ ঘর থেকে বের হবে না।

জাহিদ মালিক ধরেই নিয়েছেন, মেডিকাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেই। এবার যেটা করতে হবে, সেটার বিস্তার রোধ। বিশেষ করে ফেসবুকে লোকে ছবি দিয়ে দেবে, ‘এই যে প্রশ্নপত্র, ফাঁস হয়েছে কি না, পরীক্ষার পর মিলিয়ে দেখুন’, সেটা তিনি করতে দেবেন না। একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও। যাঁকে প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে, শুধু তিনিই এটার স্বাদ আস্বাদন করবেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইনবক্সে চালাচালি করার দরকার কী! আর ফেসবুকে এটার ছবি প্রকাশ করারই–বা কী হলো!

আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধ করতে পারব না। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেই। শুধু এটা যে ফাঁস হয়েছে, সেটার কোনো প্রমাণ রাখব না। কাজেই আমরা ইন্টারনেটের গতি দেব কমিয়ে।

এই মন্ত্রীকে কেউ কি বলবেন, ইন্টারনেটের গতি কমাতে হবে না, ইন্টারনেটের গতি কমই আছে। ঢাকাতেই কোনো মুঠোফোনে একবারে কল করা যায় না। ফোর–জি, থ্রি–জি তো দূরের কথা, যা পাওয়া যায়, তার নাম জি-না! এই রকম নেটওয়ার্ক আর গতি দিয়েও যে আমরা ফেসবুক চালাচ্ছি, তা আমরা নিতান্তই স্মার্ট বলে! সেই যে কৌতুক ছিল, আমার মা বন্দুক নিয়ে বনে গেছেন বাঘ শিকার করতে, গিয়ে দেখেন, গুলি নাই, তিনি বন্দুক দিয়েই বাঘ শিকার করে এনেছেন। তখন আরেক চাপাবাজ বলে বসল, আমার মামা বাঘশিকারে গিয়ে দেখলেন, গুলি নাই, বন্দুকও নাই, আছে শুধু বন্দুকের লাইসেন্স, লাইসেন্স দিয়েই তিনি বাঘ শিকার করে এনেছিলেন। আমাদেরও ইন্টারনেটের গতি নাই, আছে শুধু জি-না, জি-না, তা দিয়েই আমরা হাতিঘোড়া মারছি।

দুই নম্বর কথাটাও তাঁকে বলুন। প্রশ্নপত্র যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। যুগটা ডিজিটাল, মন্ত্রী অ্যানালগ হলে চলবে না। ১০ সেট প্রশ্ন, নিদেনপক্ষে ৫ সেট প্রশ্নপত্র পাঠান। সকালবেলা ঢাকার অফিসে ভদ্রলোক ডেকে সাক্ষী রেখে লটারি করুন, কোন সেটে পরীক্ষা হবে। সেটা পরীক্ষার ১০ মিনিট আগে কেন্দ্রে জানান। এই জানানোর জন্য ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, এসএমএস ব্যবহার করুন।

মন্ত্রী বলতে পারেন, আমরা তো তা-ই করি। ব্যাটারা ৫ সেটই ফাঁস করে দিয়ে রাখে। কোন সেটে পরীক্ষা হচ্ছে জানামাত্র ফাঁস করে দেয়। তাহলে বলব, ওই ব্যাটাদের ধরুন। কঠোর শাস্তি দিন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যেন আর কোনো দিন কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সাহস না দেখায়।

আসলে সর্বাঙ্গে ব্যথা হলে ওষুধ দেবার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সমাজে নীতিনৈতিকতা বলতে কিছু নাই। আমরাও আমাদের ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বানাবই। ছেলে-মেয়েকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র এনে দেন গর্বিত বাবা-মা। কী গৌরবের কথা! বাবা-মার মুখোজ্জ্বল করবে ছেলেমেয়েরা কী, আমরাই কালি নিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে মেখে দিচ্ছি। তাতে তো অসুবিধা হচ্ছে না। সমাজ তাদেরই হাততালি দিচ্ছে। তাদের নামেই জয়ধ্বনি করছে।

কিন্তু দুষ্ট লোকেরা বলবে, কে কাকে শাস্তি দেবে। অসদুপায় অবলম্বন করে ভোটে জেতা যাবে, অসদুপায় অবলম্বন করেও দিনের পর দিন ফুলের মালা গলায় পরে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো যাবে এবং সাংবাদিক নির্যাতন করেও নির্বিকার থাকা যাবে, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা কেন বলবে না, আমাকেও ফুলের মালা দিন। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি হওয়ারাই শেষে ডাক্তার হবে। মেডিকেল কলেজে পাস করতে না পারলে আবারও ট্রিকস খাটাবে। তারপর তারাই নেতা হবে। এবং বলা তো যায় না ভূত-ভবিষ্যৎ-ভবিতব্যের কথা—একদিন তাদের মধ্যে থেকেই আমরা একজনকে পেয়ে যাব, যিনি হবেন অতিপারঙ্গম এবং অক্ষয় অদম্য অচ্যুত স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

আসলে সর্বাঙ্গে ব্যথা হলে ওষুধ দেবার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সমাজে নীতিনৈতিকতা বলতে কিছু নাই। আমরাও আমাদের ছেলেমেয়েদের ডাক্তার বানাবই। ছেলে-মেয়েকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র এনে দেন গর্বিত বাবা-মা। কী গৌরবের কথা! বাবা-মার মুখোজ্জ্বল করবে ছেলেমেয়েরা কী, আমরাই কালি নিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে মেখে দিচ্ছি। তাতে তো অসুবিধা হচ্ছে না। সমাজ তাদেরই হাততালি দিচ্ছে। তাদের নামেই জয়ধ্বনি করছে।

না। আর প্যাঁচাব না। সোজা কথা স্ট্রেটকাট বলি। ইন্টারনেট স্লো করে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাবে না। ফটোকপিয়ার মেশিন বন্ধ করেও না। ভূত থাকে সরিষাতে। সরিষা বাটতে থাকুন। ঘানিতে ঢুকিয়ে তেল বের করুন। খৈল গরুকে খাওয়ান। তেলটা নাকে দিন। না। ঘুম আসবে না। জেগে উঠবেন। ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠবে। এখন আমাদের জাগার সময়। আর যে সরিষায় ভূত আছে, তাকে পিষে পিষে তেল বের করার সময়।
সমস্যা হলো, এটা করবে কে? করবে কেন? ভূতেরাই যদি পুরস্কার পায়, তাহলে কে আর মানুষ থাকতে চায়। এই যুগটা মানুষের জন্য নয়, ‘মানুষ-না’দের জন্য!

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক