নদী যুগ যুগ ধরে বরিশালকে রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সেটা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের জন্মগত দুঃখ। আর এই বিচ্ছিন্নতার কারণে কৃষি, মৎস্য, পর্যটনশিল্পে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা পিছিয়ে ছিল। উন্নয়নের দিক দিয়েও ছিল পশ্চাৎপদ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে রাষ্ট্রীয় বণ্টন ছিল অসম।
কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের সেই দুঃখ মোচন হয়েছে। খুলে গেছে ভাগ্যদুয়ার। যোগাযোগব্যবস্থা মসৃণ হওয়ায় এখন বরিশাল আর ঢাকার দূরত্ব মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার। সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক পুনঃস্থাপিত হওয়ায় বরিশালকে ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে নতুন এক স্বপ্ন দানা বেঁধেছে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের গতি মন্থর করেছে শিল্প বিকাশের সুযোগ-সুবিধা কম। বরিশালে গ্যাস নেই। অথচ বরিশালের ভোলায় দেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে উত্তোলিত গ্যাস ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
ভোলার গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, ভোলার পাওয়া গ্যাস সেখানকার চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে ৮১ থেকে ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রতিদিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এরই মধ্যে ভোলা আরও একটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে।
ইলিশায় আবিষ্কৃত নতুন গ্যাসকূপকে ভোলার শাহবাজপুর আর ভোলা নর্থ নামে বর্তমানে আলাদ যে দুই গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, তা থেকে আলাদা মনে করছেন বাপেক্সের কর্মকর্তারা। শাহবাজপুর বা ভোলা নর্থ ফিল্ড থেকে এটা আলাদা একটা এলাকা, মাটির নিচে আলাদা একটা ফল্টে রয়েছে ইলিশার ক্ষেত্রটি। এখানে মাটির প্রায় ৩ হাজার ৪০০ মিটার গভীরে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গ্যাস রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছর ভোলার উদ্বৃত্ত সেই গ্যাস ক্যাসকেড সিলিন্ডার পদ্ধতিতে অন্যত্র সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাইপলাইন স্থাপন না করায় সেই গ্যাস ভোলাবাসী যেমন পাচ্ছে না, তেমনি বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অথচ ভোলার গ্যাস সিলিন্ডারে করে নিয়ে ঢাকার রপ্তানিমুখী শিল্পাঞ্চলে কাজে লাগানো হচ্ছে। এটাকে অন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখানে গ্যাসের সরবরাহ রয়েছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
প্রায় ছয় শ থেকে সাত শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সরকার সিএনজিতে রূপান্তর করে কনটেইনারে ভরে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে ভোলার গ্যাস রপ্তানিনির্ভর শিল্পকারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে। আপাতত শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে এই গ্যাস নেওয়া হচ্ছে।
গত মার্চ মাসে এ জন্য ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ বছরের জন্য কোম্পানিটির এই সরবরাহ কাজ করার কথা।
পরিতাপের বিষয় হলো বরিশাল অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে ভোলা গ্যাস পুরো দক্ষিণাঞ্চলের আবাসিক ও শিল্প খাতে সরবরাহের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে বরিশালের এক জনসভায় এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
২০২২ সালে পদ্মা সেতু চালুর পর এই দাবি শতভাগ যৌক্তিক। বরিশালের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, তাকে কাজে লাগাতে হলে গ্যাস আনার কোনো বিকল্প নেই।
এখন ঢাকা থেকে কিংবা খুলনা থেকে কুয়াকাটা যেতে আর কোনো ফেরি নেই। কিন্তু এরপরও নিরবচ্ছিন্ন এই যোগাযোগব্যবস্থার সুফল পাচ্ছেন না বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। এর পেছনে একমাত্র কারণ গ্যাস। গ্যাস সংযোগ স্থাপন না হওয়ায় কেবল বিদ্যুতের ওপর ভর করে এখানে এখনো শিল্পকারখানা স্থাপনের ঝুঁকি নিচ্ছেন না কেউ।
পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর মাওয়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশকে ঘিরে দেশের বড় শিল্পোদ্যোক্তারা জমি কিনেছেন। আবার বেকুটিয়া সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর খুলনা ও মোংলার সঙ্গে বরিশাল ও পায়রা বন্দরের যোগাযোগে নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। দুটি সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে আন্তযোগাযোগ সহজ হওয়ায় এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিতেও কোনো বাধা নেই।
এখন ঢাকা থেকে কিংবা খুলনা থেকে কুয়াকাটা যেতে আর কোনো ফেরি নেই। কিন্তু এরপরও নিরবচ্ছিন্ন এই যোগাযোগব্যবস্থার সুফল পাচ্ছেন না বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। এর পেছনে একমাত্র কারণ গ্যাস। গ্যাস সংযোগ স্থাপন না হওয়ায় কেবল বিদ্যুতের ওপর ভর করে এখানে এখনো শিল্পকারখানা স্থাপনের ঝুঁকি নিচ্ছেন না কেউ।
গ্যাস কেন প্রয়োজন
জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, তার বড় ভুক্তভোগী এ অঞ্চলের মানুষ। সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, দারিদ্র্য হার কমছে না বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অশনিসংকেত। এ জন্য এ অঞ্চলে দারিদ্র্য কমাতে, সম্ভাবনাগুলোকেও কাজে লাগাতে ভোলার গ্যাস কার্যকর সমাধান হতে পারে।
বরিশালকে ঘিরে বিপুল সম্ভাবনার কথা আলোচিত হচ্ছে জাতীয়ভাবে। এরই মধ্যে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা বন্দর ও বরগুনার তালতলী উপজেলা ঘিরে দেশের অন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদনের হাব গড়ে তোলা হয়েছে।
পটুয়াখালীতে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। বরিশালের লামছড়িতে আরও একটি ইপিজেড করার আলোচনাও চলছে। এসব সম্ভাবনাই বাস্তবে রূপ নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে বরিশালে ভোলার গ্যাস আসা না–আসার ওপর। কেননা, গ্যাস ছাড়া শিল্পের বিকাশ একেবারেই অকল্পনীয়। পদ্মা সেতু চালুর পর যে গতিতে বরিশালের অর্থনৈতিক খাত এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। গত দুই বছরেও বরিশালে ভারী কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার নজির নেই। এ জন্য এ অঞ্চলের দারিদ্র্য আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।
রংপুরকে একসময় বলা হতো মঙ্গাকবলিত এলাকা। কিন্তু গত ছয় বছরের ব্যবধানে রংপুরে দরিদ্রতা কমেছে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। বিপরীতে একই সময়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ দরিদ্রতা বেড়েছে বরিশাল বিভাগে। শুধু তা–ই নয়, জাতীয়ভাবে দরিদ্রতার চেয়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হার বেশি বরিশালে। এটা কোনোভাবেই আশার খবর নয়।
আঞ্চলিক স্বার্থে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমঝোতা প্রয়োজন
ভোলার গ্যাস সিলিন্ডারজাত করে ঢাকার শিল্পাঞ্চলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর বরিশালে এর প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাসদ নেতা মনীষা চক্রবর্তী। এই দাবিতে বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুরের জেলায় নাগরিক কমিটিও গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন হলেও ভোলার গ্যাস ঢাকার শিল্পাঞ্চলে নেওয়া যেমন রোধ হয়নি, তেমনি পাইপলাইন স্থাপনের ব্যাপারে সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি।
তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে বরিশাল অঞ্চলের নেতাদের ঐকমত্যের নজির এই বিভাগে খুব কমই আমরা দেখেছি। ভোলার গ্যাস বরিশালে আনার ব্যাপারেও তা ব্যতিক্রম নয়।
চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সেখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দলীয় মতপার্থক্য ভুলে স্থানীয় উন্নয়নের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছানোর নজির আছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক খাতে সমৃদ্ধির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক এবং অভিন্ন অবস্থানে থাকেন, এটা ওই অঞ্চলের জন্য একটি বড় আশীর্বাদ।
কিন্তু বরিশালে কেন আমরা সেই ধরনের নজির স্থাপন করতে পারিনি, সেটা বড় প্রশ্ন। কারণ, গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। শুধু নাগরিকদের আন্দোলন সেখানে খুব বড় একটা চাপ তৈরি করতে পারে না। যতটা পারে রাজনৈতিক নেতৃত্বে সক্রিয় তৎপরতা। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সোচ্চার ভূমিকা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দলমত–নির্বিশেষে আঞ্চলিক উন্নয়নকে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়ার সংস্কৃতিটা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ নির্বাচন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ একটানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। বৃহত্তর বরিশাল ও ফরিদপুরের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এবং এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হলে সরকারের পক্ষে এই দাবি অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।
একটা কথা তো সত্য, এ অঞ্চলে শিল্পের বিকাশ হলে অর্থনীতি গতি পাবে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য কমবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনীতি, রাজনীতি ও জীবনব্যবস্থায়। রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে এ অঞ্চলের মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এতটুকু কি খুব বেশি চাওয়া?
এম জসীমউদ্দিন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
ই–মেইল: [email protected]