নির্বাচন পার করতেই ফখরুল–খসরুদের জেলে রাখা হয়েছিল?

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কর্মীরা ফুল দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলামকে শুভেচ্ছা জানানছবি: দীপু মালাকার

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে জামিন পেতে যাচ্ছেন, সেটা আগেই ধারণা করা গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে।

৯ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডিতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যতটুকু জানি, অনেক মামলায় তাঁর জামিন হয়েছে। একটি মামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তাঁর ক্ষেত্রে একটু অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো একটা সময় জামিন হয়ে যাবে। একজন বিনা বিচারে আটকে থাকবে, এটা সরকারও চায় না। জামিন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না, এটা ঠিক নয়।’ (বাংলা ট্রিবিউন)

বৃহস্পতিবার বিকেলে মির্জা ফখরুল ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হলে দলীয় নেতা-কর্মীরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। মির্জা ফখরুল বিজয় না হওয়া পর্যন্ত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং একপক্ষীয় নির্বাচন করে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

আরও পড়ুন

৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এসে ভুল করেছে, এর খেসারত অনেক দিন দিতে হবে। 

ক্ষতি ও খেসারত যদি দুই দলের মধ্যে সীমিত থাকত, দুশ্চিন্তা কম হতো। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারি যেভাবে ভোট হলো, তাতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলো। জনগণের বৃহত্তর অংশ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। এই নির্বাচনে কোন দল কতটি আসন পেয়েছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সেখানে প্রার্থী বাছাই করার সুযোগ ছিল কি না। নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। 

বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যত মামলাই দেওয়া হোক না কেন, তাঁদের আটক করার আসল কারণ ছিল নির্বাচন পার করা। যেভাবেই হোক সরকার সেটি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য, জনগণ বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেননি। আবার এটাও সত্য যে তাঁরা উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে ভোটকেন্দ্রেও যাননি।

নির্বাচন মানে তো বাছাই করার উন্মুক্ত সুযোগ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সেটা আদৌ ছিল না। ভোটকেন্দ্রের বাঁয়ে নৌকা, ডানে স্বতন্ত্র। এমনকি জাতীয় পার্টির যে ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হন, তার পেছনেও ক্ষমতাসীন দলের ‘অনুকম্পা’ ছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসেনি বলেই এমনটি হয়েছে। বিএনপির নেতাদের জবাব, সরকারই চায়নি বিএনপি নির্বাচনে আসুক। দুটির মধ্যেই সত্যতা আছে।

বিএনপি যখন বুঝেছে সরকার তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে চাইছে, তাদের উচিত ছিল না যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা। ২০০৬-০৭ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে এম হাসান কিংবা তাঁর স্থলে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে মেনে নেয়নি। তারপরও তারা শুরু থেকে নিজেদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখেনি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগপর্যন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। 

এবার বিএনপি তার রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে অতি আস্থাশীল ছিল এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ার পর নেতা-কর্মীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।

সদ্য কারামুক্ত বিএনপির দুই নেতাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন। এতে দলীয় নেতা-কর্মীরা কতটা আশ্বস্ত হবেন, তা বলা মুশকিল। 

গত ২৮ অক্টোবরের আগপর্যন্ত বিএনপি যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিল, তার প্রতি ব্যাপক মানুষের সমর্থন ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত দীর্ঘ সময় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার নজির নেই। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হঠাৎ ছেদ পড়ল কেন, সেটাও বিএনপিকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। তারা যদি জানতই ওই দিনের সমাবেশকে সরকার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তারা সেই ফাঁদে পা দিল কেন?

২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির যেসব নেতা-কর্মীর সঙ্গে আলাপ হলো, তাঁদের মধ্যে হতাশা লক্ষ করেছি। এই হতাশার কারণ নেতৃত্ব তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তাঁরা নির্বাচনটি ঠেকিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা এ কথা ভাবলেন না যে বাংলাদেশে আন্দোলন করে কোনো দল বা জোট নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দিতে পারেনি। একতরফা কিংবা ভোটারবিহীন যা–ই বলি না কেন, নির্বাচন একবার হয়ে গেলে সেটা উল্টে দেওয়া কঠিন।

আরও পড়ুন

বিএনপির এক দফা আন্দোলনের কয়েকটি ভুলের একটি হলো, বিকল্প পরিকল্পনা না রাখা। তারা সরকারের পদত্যাগ চেয়েছে, কিন্তু সরকার পদত্যাগ না করলে বিএনপি কী করবে, সেটা নেতারা ভাবেননি। দ্বিতীয় ভুল, তারা সরকারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। জনগণের মধ্যে আরও একটি ধারণা জন্মে যে বিএনপি এক দফার আন্দোলনে জনগণের চেয়ে বিদেশি বন্ধুদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তৃতীয়ত, বিদেশি বন্ধু বলতে তারা একটি দেশকেই বুঝিয়েছে। ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশের অন্যান্য বন্ধুকে অগ্রাহ্য করেছে। নির্বাচন প্রশ্নে রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে তারা অনেকটা বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। চতুর্থত, বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের ডাক কোথা থেকে এসেছে, জনগণ দূরের কথা; দলের নেতা-কর্মী কিংবা জোটের শরিকেরাও জানতেন না।

কিন্তু বিএনপির আন্দোলনের এসব দুর্বলতা ও ব্যর্থতা কোনোভাবে ৭ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচনকে শুদ্ধতা দেয় না। সরকার যদি সত্যি সত্যি চায় দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসুক, রাজপথে হানাহানি না হোক, তাহলে বিএনপির নেতা–কর্মীদের গায়েবি, গয়রহ মামলা থেকে রেহাই দেওয়া। রাতে তঁাদের বাসা থেকে ধরে এনে নতুন করে মামলায় অভিযুক্ত করা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। নির্বাচনের পরও হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আটক রাখার অর্থ হলো এই মুহূর্তে রাজপথে প্রায় নিষ্ক্রিয় বিএনপিকেও সরকার ভয় পায়? 

জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে আগামী ৯ মার্চ। এরপর মে মাসে চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হলো বিএনপি কী করবে? বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল ‘এই সরকারের অধীনে’ কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। যদিও সিটি করপোরেশনসহ বেশ কিছু নির্বাচনে বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ জিতেও এসেছেন। এবার উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্বের উচিত ‘কঠোর অবস্থান’ থেকে সরে এসে দলের নেতাদের প্রতি নমনীয়তা দেখানো। এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি অভিজ্ঞতা বলি।

দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রার্থীর বিপরীতে বিএনপির দুই নেতা দাঁড়িয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। তাঁদের মিলিত ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থীর দেড় গুণ হলেও নৌকা জিতে যায়। এবারের মেয়র নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিপরীতে বিএনপির ওই দুই ‘বহিষ্কৃত’ নেতা লড়ছেন। দেখা যাক ফলাফল কী হয়। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

আরও পড়ুন