ইউরোপে বিশ্বমানের প্রতিযোগী প্রযুক্তি কোম্পানির অভাব নিয়ে ইউরোপীয়রা বহুদিন ধরেই আক্ষেপ করে আসছে। এ অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর ইউরোপের নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
মার্কিন প্রযুক্তি ধনকুবেররা ইউরোপের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছেন আর ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপের ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করছে। ফলে এই নির্ভরতা এখন আর শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি ইউরোপের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।
ইউরোপীয়রা এটি ভালোভাবেই বুঝছে। তবে কীভাবে জবাব দেওয়া উচিত, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে দুই ধরনের মত আছে। একটি পক্ষ মনে করে, ট্রাম্পের চাপের কাছে নত না হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। তাদের মতে, আরও উচ্চাভিলাষী নীতি নিয়ে এই কোম্পানিগুলোর বাজারে আধিপত্য ভাঙতে হবে এবং তাদের পণ্যের সামাজিক ক্ষতি কমাতে হবে।
অন্য পক্ষ মনে করে, প্রযুক্তি খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বাড়ানো দরকার। এতে বিদেশি চাপের কাছে ইউরোপের দুর্বলতা কমবে এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাও বাড়বে।
ইউরোপে বিশ্বমানের প্রযুক্তি কোম্পানি না গড়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ দায়ী নয়। মূল সমস্যা হলো যথাযথ প্রয়োগের অভাব। ইউরোপীয় কমিশনের একচেটিয়া ব্যবসা ভেঙে দেওয়ার এবং ক্ষতিকর অধিগ্রহণ ঠেকানোর ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা খুব কমই এই ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। কারণ, তারা ভেবেছে, এতে উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হতে পারে অথবা যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
দেখতে আলাদা লাগলেও এ দুই অবস্থান আসলে খুব দূরের নয়। শক্তিশালী, ভালোভাবে পরিকল্পিত ও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির বিশেষ সুবিধা কমাতে পারে। এতে নতুন কোম্পানিগুলোর এগিয়ে আসার সুযোগ বাড়বে। এতে গণতন্ত্র ও উন্মুক্ত, বিকেন্দ্রীভূত বাজারকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মান ও নীতিমালাও আরও শক্ত হবে।
একই সঙ্গে যদি ইউরোপের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল এবং ক্লাউড কম্পিউটিং সক্ষমতা গড়ে ওঠে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা ও সার্বভৌমত্ব অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।
দুঃখজনকভাবে এ দুই অবস্থানের পরিপূরক সম্পর্ক খুব কমই স্বীকার করা হয়। বরং ‘আগে প্রতিযোগিতা’—এই নীতির অনুসারী শিবিরটি সাধারণত মনে করে, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সময়ের অপচয়। কারণ, অতীতেও বিগ টেককে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। কেউ কেউ আবার নিয়ন্ত্রণকে ইউরোপের প্রযুক্তি-আকাঙ্ক্ষা নষ্ট করার জন্য দায়ী করে।
ইউরোপে বিশ্বমানের প্রযুক্তি কোম্পানি না গড়ে ওঠার জন্য অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ দায়ী নয়। মূল সমস্যা হলো যথাযথ প্রয়োগের অভাব। ইউরোপীয় কমিশনের একচেটিয়া ব্যবসা ভেঙে দেওয়ার এবং ক্ষতিকর অধিগ্রহণ ঠেকানোর ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা খুব কমই এই ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। কারণ, তারা ভেবেছে, এতে উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হতে পারে অথবা যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
যেখানে কোথাও প্রয়োগের ফলে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেখানে ইউরোপীয় কোম্পানির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো সেই সুযোগ বেশি কাজে লাগিয়েছে। তবে গবেষক আনু ব্রাডফোর্ডের মতো ব্যক্তিরা বলেন, এর পেছনে আরও কারণ রয়েছে। যেমন সদস্যদেশগুলোর মধ্যে নিয়মের পার্থক্য, দুর্বল পুঁজিবাজার, কঠোর দেউলিয়া আইন, ঝুঁকি নিতে না চাওয়ার সংস্কৃতি এবং বিদেশি মেধা আকর্ষণে সমস্যা।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা। বিশেষ করে প্রতিযোগিতা আইন ঠিকমতো প্রয়োগ না করায় বিগ টেক ইউরোপের সম্ভাবনাময় স্টার্টআপগুলো হয় ধ্বংস করেছে, নয় অধিগ্রহণ করেছে। যেমন পর্তুগালের অ্যাপ স্টোর অ্যাপটয়েড, সুইডেনের আইজেটল, এস্তোনিয়ার স্কাইপ ও ব্রিটেনের ডিপমাইন্ড।
এ কারণে বলা যায়, ইউরোপে শক্তিশালী প্রযুক্তিশিল্প গড়ে তুলতে হলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ জরুরি। বিশেষ করে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
ম্যাক্স ফন থুন ওপেন মার্কেটস ইনস্টিটিউটের ইউরোপ ও ট্রান্সআটলান্টিক অংশীদারি বিভাগের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত