ঐক্যের ৩৩ বছর, কোন পথে জার্মানি

‘৩৩ বছর আগে জার্মানির ঐক্য কেন ঘটেছিল, এই নিয়ে এখন জার্মানিতে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।’

৩৩ বছর আগে পূর্ব জার্মানির নাগরিকেরা পথে নেমেছিলেন অধিক গণতন্ত্রের জন্য। গণতন্ত্র আর সমাজতান্ত্রিক ঘরানা থেকে বের হয়ে আসতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আজকে তাঁরাই আবার গণতন্ত্রের অনুশাসন মানছেন না। অধিক গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে ক্রমেই সাবেক পূর্ব জার্মানির পাঁচটি অতি জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচারী রাজনীতির ধারক হয়ে উঠছেন। তার ছায়া পড়েছে পশ্চিমেও। অতি জাতীয়তাবাদীদের এই উত্থান আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জার্মানির সমকালীন রাজনীতিতে।

তদুপরি ঐক্যভূত জার্মানির ৩৩ বছর পূর্তিতে জার্মানির বেশি ভাগ মানুষ বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করেন। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, নানা অসংগতি, অপ্রাপ্তি এবং বিশাল ব্যয় সত্ত্বেও জার্মান পুনরেকত্রীকরণ দেশটির জন্য, শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক সাফল্যও এনে দিয়েছে।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জার্মান জাতি বিভক্ত হয়েছিল নাকি বিভক্ত করা হয়েছিল, ইতিহাসে সেই আলোচনা এখনো সরব। তবে যুদ্ধাপরাধের দায় মেনে নিয়ে, ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি নাম দিয়ে দেশটি বিভক্ত হয়েছিল, সেটিই ঐতিহাসিক সত্য। ৪১ বছর বিভক্ত থাকার পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর জার্মান জাতি আবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

আরও পড়ুন

৩৩ বছর আগে জার্মানির ঐক্য কেন ঘটেছিল, এই নিয়ে এখন জার্মানিতে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আর জার্মান সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। ঐক্যের আগে পূর্বাঞ্চলের যে মানুষেরা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উন্মুক্ত সমাজ ও ঐক্যবদ্ধ জার্মানির স্বপ্নে বিভোর ছিল, এখন কি তাদের সেই স্বপ্নের ভঙ্গ ঘটেছে, বা তা নিয়ে পশ্চিমের মানুষদেরই মূল্যায়ন কী!

১৯৯৭ সাল থেকে, জার্মান সরকার দেশটির ঐক্য পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। ২০২২ সালে জার্মান পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার কারস্টেন স্নাইডার বার্ষিক প্রতিবেদনে পেশ করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের ৬১ শতাংশ মানুষ জার্মান জাতির ঐক্যকে ইতিবাচক বলে মনে করেন।

প্রতিবেদনে পূর্ব জার্মানিতে সম্পদ এবং আয়ের মাত্রা এখনো পশ্চিমের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। শরণার্থী বা করোনাকালীন সংকট, ইউক্রেনের যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং জ্বালানি-সংকট ইত্যাদি নিয়ে সাবেক পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের মধ্য হতাশা রয়েছে। আর পূর্বাঞ্চলের মাত্র ৩৯ শতাংশ নাগরিক বর্তমানে জার্মানিতে প্রচলিত গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট। গত তিন দশকেরও বেশি সময়ে, ঐক্যবদ্ধ জার্মানি, শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্য আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

জার্মান জাতির পুনঃ ঐক্যের ৩৩ বছর পূর্তির প্রাক্কালে অর্থনৈতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দুই অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। তবু ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জার্মানির অর্থনীতি ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। সাবেক পূর্ব জার্মানির পুনর্বাসন ও উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে এই অর্জন বিস্ময়কর।

জার্মানির টেলিভিশন চ্যানেল জেডডিএফ একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হলো পোলিট ব্যারোমিটার, অর্থাৎ রাজনীতির থার্মোমিটার। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা জরিপ করে থাকে।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, জার্মানির অতি জাতীয়তাবাদী দল এফডি বা অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড দলটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন সরকারের বড় দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা আছেন তৃতীয় সারিতে আর প্রথম সারিতে আছেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা। বিষয়টি নিয়ে জার্মানির মূলধারার রাজনৈতিক দল সামাজিক গণতান্ত্রিক দল ও ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে অনেকে দায়ী করছেন।

সম্প্রতি ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট রোন্ডশু’ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জার্মানির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য থুরিংঙ্গেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাম দলের বোডো রামেলো বলেছেন, শুধু জার্মানির পূর্বাঞ্চল নয়, জাতীয়তাবাদী প্রবণতা ইউরোপজুড়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যা শুধু জার্মান নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য উদ্বিগ্নতার কারণ হতে পারে। তিনি মনে করেন, পূর্বাঞ্চলের মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা জরুরি। তাদের অনেকের দৃষ্টিতে, তারা পশ্চিম জার্মানদের দ্বারা তৈরি রাজনীতির শিকার এবং তারা নিজেদের প্রান্তিক নাগরিক বলে মনে করেন।

আরও পড়ুন

৩৩ বছর আগে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্য পুনরেকত্রীকরণ ঘটলেও দুই অঞ্চলের মধ্য কিছু বিভেদ ছিল। সাবেক পশ্চিম জার্মানি বা জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই একধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি—এসব সেবার ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা বজায় ছিল, যা এখনো রয়েছে।

আর সাবেক পূর্ব জার্মানি বা পূর্বাঞ্চল ছিল সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী কাঠামোর রাষ্ট্র। গত ৩৩ বছরে পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি-আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আর এসব করতে পশ্চিমের নাগরিকদের দীর্ঘ সময় ধরে সংহতি ভ্যাট প্রদান করতে হচ্ছে। আদতে ১৬০ লাখ মানুষ-অধ্যুষিত পূর্ব জার্মানিকে নতুন ধাঁচে গড়ে তোলার বিষয়টি খুব সহজ ছিল না।

জার্মান জাতির পুনঃ ঐক্যের ৩৩ বছর পূর্তির প্রাক্কালে অর্থনৈতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দুই অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। তবু ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জার্মানির অর্থনীতি ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। সাবেক পূর্ব জার্মানির পুনর্বাসন ও উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে এই অর্জন বিস্ময়কর।

১৯৯০ সালে জার্মান জাতির ঐক্যের অন্যতম নায়ক সাবেক জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল বলেছিলেন, ‘জার্মান জাতির গৌরব করার তেমন কিছু নেই। তবে বার্লিন প্রাচীরের পতন ও জার্মান জাতির একত্রীকরণ নিয়ে আমরা গর্বিত।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্য জনসংখ্যায় বড় এবং অর্থনীতিতে সবল দেশ জার্মানির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সব সময় ইউরোপীয় রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সে ক্ষেত্রে চলমান ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কে জার্মানরা সামরিক সহায়তার বিকল্প হিসেবে আরও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পক্ষে। কিন্তু মার্কিনি যুদ্ধনীতি থেকে বেরিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থে জোটের দুই বড় দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স ইইউ জোটের আত্মপরিচয় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। মার্কিন ভূরাজনীতি তাতে বাদ সেধেছে।

এই বছর জার্মান পুনরেকত্রীকরণ উৎসব পালিত হচ্ছে এলব নদীতীরে বন্দর শহরে হামবুর্গে। জার্মান ঐক্যের ৩৩ বছর স্মরণে ‘ভবিষ্যতের জন্য উন্মুক্ত দিগন্ত’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ জার্মানির ৩৩ বছর পূর্তিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জার্মান জাতি অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
    [email protected]