আলোচনার ঝড় দেখে মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যার নাম রাসেলস ভাইপার। এ নিয়ে মূলধারার এবং ‘নৈরাজ্যবাদী’ সব ধরনের গণমাধ্যমেই গল্পের ছড়াছড়ি।
এই সাপ নিয়ে এখন ‘কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’র মতো অবস্থা গ্রামে, মফস্সল শহরে, নগরে।
অপরিণত, অপরিণামদর্শী সামাজিক প্রভাবকের (সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার) স্ট্যাটাস, কারও উল্টোপাল্টা কাজ কারবার এবং কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটারের ‘কীর্তি’ নিয়ে এমন শোরগোল তোলা হচ্ছে যেন জাতির কোনো আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নেই।
এ ঘটনার ঘনঘটায় অদৃশ্য সুতার টান অনুভব করতে পারেন দুষ্ট লোকেরা। চটুল খবরে হালকা বিনোদনে মানুষকে মাতিয়ে রাখতে পারলে অন্যদের ক্ষতি কী?
অতীতের স্বৈরাচারী শাসকেরাও বড় খেলার আসর বা বিনোদন মেগাস্টার ভাড়া করে এনে জনগণকে ‘আফিমে’ বন্দী রাখতে উদ্যোগ নিতেন।
এই তো পনেরো লাখ টাকা দিয়ে কোরবানির ছাগল কিনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তার ছেলে শিরোনামে এল, যাকে বলা হচ্ছে ছাগল–কাণ্ড, তা-ই কীভাবে যেন হয়ে পড়ল এ সময়ের অন্যতম দুর্নীতির ঘটনা! এই আলোচনার বাড়াবাড়িতে মনে হচ্ছে, অন্য সব রাঘববোয়াল ধোয়া তুলসী পাতা।
অথচ কদিন আগেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে তুমুল আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ; তারপর স্বল্প পরিসরে ঢাকা মহানগরের সাবেক পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং একজন কর্মরত কর্মকর্তা।
আহারে! ‘কাদায় পড়িলে হাতি, চামচিকায় মারে লাথি।’ না, এটা কাদায় পড়া হাতিও নয়। এটাকে বরং মরা হাতির গায়ে সভ্য মানুষের লাথি মারার শামিল মনে হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও মরা হাতি শিকার করতেই বেশি পছন্দ করে।
দু–একটি পত্রিকা সাহস বা কায়দা করে সাবেক কর্মকর্তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতেই খুলে গেল খবরের বাক্স। অন্যথায় খবর করার মতো তথ্যের কী যে আকাল আজকাল!
যেমন দুর্দশা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের। দেখা যাচ্ছে, তাঁদেরও কয়েকজন লাইন ধরে বেনজীর সাহেবের সমালোচনায় যোগদান করেছেন।
এসব খবর গণমাধ্যমের নতুন ও পুরোনো পাঠক ও দর্শক কি বানাতে বা ধরে রাখতে পারছে? গতকাল সন্ধ্যায় যা অনলাইনে পড়া হয়ে গেছে, আজ সকালে তা ছাপা কাগজে উপস্থাপিত হলে কী এসে যায় ব্যস্ত মানুষের?
সব টেলিভিশন চ্যানেলে একটু পরপর প্রায় একই সংবাদ বুলেটিন কতটা আকর্ষণীয় সচেতন দর্শকের কাছে?
সংবাদপত্রের কাটতি কমে যাওয়া বা টেলিভিশনের দর্শক হারানো নিয়ে মিডিয়া জগতে হাহাকার আছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব পতন নিয়ে হতাশা আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুঃখ সাংবাদিক গোষ্ঠীর নিজস্ব গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ।
সাংবাদিকতা নিয়ে অন্য গোষ্ঠীর কী ধারণা আছে, তা বোঝা যায় যখন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তাদের ‘কমরেডদের’ দুর্নীতির রিপোর্টের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিবৃতি দেয়।
তবে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন থেকে ওই বিবৃতি চ্যালেঞ্জ করে বিবৃতি এসেছে।
পুলিশের পক্ষে যুক্তি হতে পারে, অভিযোগের ভিত্তিতে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আদালতে প্রমাণসাপেক্ষ এবং প্রতিবেদনগুলোর গণ–প্রতিক্রিয়া খুব বেশি ‘জাজমেন্টাল’।
তাহলে এর আগে সন্দেহজনক কারণে বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে অপরাধী হিসেবে দেখানো, জোর করে শেখানো বুলি আওড়ানো এবং ছবি তোলানো কি খুব ন্যায়বিচারের কাজ ছিল?
একতরফা পুলিশি গল্পের সাংবাদিকতাও নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য ছিল না!
পুলিশকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
কাদের সাহেবের বক্তব্যের কিছু ‘না বলা কথা’ ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে। যেসব অভিযোগ নিয়ে এখন হইচই হচ্ছে, সেগুলো ঘটেছে তাঁদের রাজনৈতিক সরকারের আমলে এবং প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অথবা পাশ কাটিয়ে। ‘আই কি মিছা কইলাম নি?’
‘রাজ কাছারির’ কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে খুব একটা সফল হয়েছে গণমাধ্যম, তা বড় মুখ করে বলা যাবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শুরুর দিকে সেখানে কোনো খবর দেখে উৎসাহী হলে পাঠক খবরটির সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য ‘লিগ্যাসি মিডিয়া’য় ফিরে আসতেন। সেই বিশ্বাসযোগ্যতা মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের ছিল।
এখন পাঠকের সেই আস্থায়ও চিড় ধরেছে। তাঁরা এখন ভিন্ন ধরনের খবরের আশায় চলে যান সামাজিক মাধ্যমে।
দুঃখের কথা হলো, গণমাধ্যমকর্মীদের দারিদ্র্য, তাঁদের বিপদে পড়া কিংবা অসহায়ত্বের গল্পেও জনগণের আবেগময় অংশগ্রহণ দেখা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক পেশাদার সাংবাদিক বেকার হয়েছেন বা রয়েছেন।
সেটি যে শুধু ভিন্নমতের কারণে এমন নয়। মিডিয়ার ‘আত্মহননের’ পথে ভিকটিমও হয়েছেন কেউ কেউ।
গণমাধ্যম চরম সংকটে থাকলে নাগরিকেরা মহাবিপদে পড়বে—এমন ধারণা অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব মানুষের মনে তৈরি করতে পারেনি।
গদি মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকেরা কোন আহ্লাদে সরব সাংবাদিকদের ভালোবাসতে যাবেন? সাংবাদিকতা হেরে গেলে ক্ষতি কার? পেশাদার সাংবাদিকদের আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়ে কিংবা অন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিতে স্থানান্তর করা অব্যাহত থাকলে সেটি কী ধরনের পরিণতি বয়ে আনতে পারে, তা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
পেশাদার প্রাসঙ্গিকতা কতখানি আছে তা যেখানে জানা নেই, সেখানে সাংবাদিকদের ক্লাব, ফোরাম বা সমিতির অনুষ্ঠানপ্রিয় কাজকারবার নিয়ে অনেকের উৎসাহে অবাক হতেই হয়।
আপনি যা করছেন তা যদি সাংবাদিকতাই না হয়, পাঠক-দর্শক আপনাকে সাংবাদিক মানবে কোন যুক্তিতে?
স্নাতক পর্যায়ে হরলাল রায়ের লেখা বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে একটি রচনা ছিল ‘পরীক্ষায় ফেল করিলে আমি কী করিব’। রচনাটি একজন পরীক্ষার্থীর জবানিতে কর্তৃবাচ্যে লেখা।
সে রচনায় পরীক্ষার্থীটি ফেল করলে কী করবে তার ফিরিস্তি দিয়েছিল। রচনার শেষের দিকে ওই পরীক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেয়, ‘পরীক্ষায় ফেল করিলে আমি দরবেশ সাজিব।’
কিন্তু এই করপোরেট দৌরাত্ম্যের জামানায় দরবেশ সাজতেও অনেক টাকা লাগে; নিদেন পক্ষে টাকা বানানোর ব্যবস্থা থাকতে হয়!
সাংবাদিকতা ব্যর্থ হলে ‘আমরা কী করিব’; সে প্রশ্নের উত্তর পেতে আগে ‘আমরা’ মানে কারা, সে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
এই ‘আমরা’র মধ্যে যদি কুকর্ম ঢাকতে চাওয়া কতিপয় সংবাদ মাধ্যমের কতিপয় গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলেই বিপদ। কারণ, সেই দূষিত গোষ্ঠীর চাওয়াই হলো রাষ্ট্রের গণমাধ্যম নামক চতুর্থ স্তম্ভটি ভেঙে ফেলা।
গদি মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকেরা কোন আহ্লাদে সরব সাংবাদিকদের ভালোবাসতে যাবেন?
সাংবাদিকতা হেরে গেলে ক্ষতি কার? পেশাদার সাংবাদিকদের আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়ে কিংবা অন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরিতে স্থানান্তর করা অব্যাহত থাকলে সেটি কী ধরনের পরিণতি বয়ে আনতে পারে, তা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।