কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী ও পাহাড়ে রাজনৈতিক সংকট

সবুজ পাহাড়ে পাকা জুম ধান কাটতে ব্যস্ত এক দম্পতি। ছবিটি রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নের সাপছড়ি পাহাড় থেকে তোলা।ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

মারমা ও রাখাইন লোকসাহিত্যে ‘তা-বং’ বলে একটি শব্দ আছে। এটি একধরনের ভবিষ্যদ্বাণী। এই ভবিষ্যৎবাণীগুলো প্রবাদ প্রবচন, কবিতা বা গানের আকারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়।

কিছু ক্ষেত্রে এগুলোকে আত্মিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চাকমা, রাখাইন, মারমা, খিয়াংসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকসাহিত্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে।

গল্পে একটি কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলা হয়েছে, যার দ্বারা একটি রাজনৈতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

রংরাং পাখির আর্তনাদ

এক বনে এক কুনো ব্যাঙ বাস করত। সে একদিন শহরে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে ব্যাঙটি তার ছোট পাখি বন্ধুকে জানায়, অচিরেই মহা ঝড় আসবে, ভয়ানক ভূমিকম্প হবে, মাটির নিচের বুনো আলু সাত টুকরা হয়ে যাবে, পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে। সর্বোপরি মানবসমাজ চার ভাগে ভাগ হবে। আর এই দুর্যোগে ছোটদের অস্তিত্ব কেবল তখনই রক্ষা পেতে পারে, যদি তারা বড়দের কাছে আশ্রয় পায়।

এদিকে ঝড় শুরু হলে ভয়ার্ত ছোট পাখিটি রংরাং নামক পাখির হাঁ করা মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে আর পশ্চাদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে রংরাং পাখি বিকট স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। তার আর্তনাদ থেকে কিছু ঘটনাপ্রবাহের জন্ম হয়। চমকে গিয়ে একটি বানর তার হাতে থাকা কুমড়া ফেলে দেয় গাছের নিচে শুয়ে থাকা একটি অজগরের ওপর; এতে অজগর ক্ষিপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী এক মুরগির ডেরায় গিয়ে তার সব ডিম সাবাড় করে ফেলে; এই ঘটনায় শোকে-দুঃখে মুরগি গিয়ে একদল পিঁপড়ার বাসা লন্ডভন্ড করে দেয়; এতে পিঁপড়ার দল রাগের মাথায় এক শূকরের গোপনাঙ্গে গিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়; আর হতবিহ্বল শূকর ছুটে গিয়ে এক বিধবার জুমখেতের সব ফসল নষ্ট করে ফেলে; দুঃখভারাক্রান্ত বিধবাটি রাজার কাছে গিয়ে নালিশ করে। আর রাজা তদন্ত করার পর কুনো ব্যাঙকে দোষী সাব্যস্ত করে। কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই এসব দুর্ঘটনার সূত্রপাত।

আরও পড়ুন

শিশুদের জন্য রচিত বিনোদনমূলক গল্প হলেও এর গভীরে যেন লুকিয়ে আছে একধরনের আগাম বার্তা। এটি পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করে, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল ও বৈরী রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সৃষ্ট আদিবাসীদের নানা বঞ্চনার গল্প।

কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী, ‘পাহাড়ের নারীরা সমতলে স্থানান্তরিত হবে এবং সমতলের নারীরা স্থানান্তরিত হবে পাহাড়ে’ মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার প্রতিচ্ছবি।

ভূগর্ভস্থ বুনো আলুর সাত ভাগে বিভাজনের কথা যেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ‘ভাগ করো। শাসন করো’ নীতির ফলে পাহাড়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দল ও উপদলের ভেতর বিভক্তির রাজনীতিকেই নির্দেশ করে।

১৯৭১ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক স্থায়ী চক্র বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাঠামোগত বৈষম্য বেড়েছে। কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী যেন এই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। ভূমি হারানো, অস্তিত্বের সংকট ও রাজনৈতিক বঞ্চনা যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বাস্তবতা।

জনমিতিগত প্রকৌশল

জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে পাহাড়ে সরকারি উদ্যোগে ১৯৭০–৮০ দশকে চার লাখেরও বেশি বাঙালি পরিবারকে পাহাড়ে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে পাহাড়ের জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে যায় এবং বিপুলসংখ্যক পাহাড়ির ভূমি বেহাত হয়ে যায়। ৭০ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে। গুচ্ছগ্রাম তৈরি ও স্থানান্তর, ভূমি বেদখল ও ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, বিদ্রোহ দমন প্রক্রিয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা, গণহত্যা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন—সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক গভীর রাজনৈতিক সংকট।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের মুহূর্ত
ছবি : সংগৃহীত

সংলাপ ও ১৯৯৭ সালের চুক্তি

বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে মোট ২৬ দফা আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চুক্তিতে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও একটি ভূমি কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোকে আরও শক্তিশালী করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রতিষ্ঠা, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চুক্তিতে অস্থায়ী সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহার, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, স্থায়ী বাসিন্দাদের ভিত্তিতে একটি ভোটার তালিকা প্রণয়ন, এবং সেই তালিকার ভিত্তিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচন আয়োজন করা প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু প্রায় তিন দশক অতিক্রান্ত হলেও এসব প্রতিশ্রুতির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জানিয়েছে, মাত্র ২৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত, আর ২৯টি ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তারা আরও উল্লেখ করে যে চুক্তির বহু ধারা নিয়মিতভাবে লঙ্ঘিত হয়ে আসছে।

বর্তমান সংকট: ভূমি বেদখল, বিচারহীনতা ও স্থবিরতা

জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্সসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। তবে বাঙালি সেটলার গোষ্ঠীগুলোর চাপের কারণে এসব বৈঠক বারবার স্থগিত করা হয়।

এদিকে মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের নেতাসহ ৩৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি বিবৃতির মাধ্যমে গত ১৯ অক্টোবর ২০২৫ নির্ধারিত ভূমি কমিশনের বৈঠক স্থগিত করায় তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, ২৪ বছর ধরে কমিশন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এবং ২৬ হাজারের বেশি অমীমাংসিত মামলা থাকা অবস্থায়ও প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় কমিশনের কার্যক্রম বারবার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তারা ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা এবং ব্যাপক সেনা উপস্থিতি সত্ত্বেও নিরাপত্তাহীনতার বিভিন্ন ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা কমিশনের কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে স্বাধীন তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান, যাতে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। (ডেইলি স্টার, ২০ অক্টোবর ২০২৫)।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অনীহার সমন্বিত ফল। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সত্ত্বেও পাহাড়ে যে সহিংসতা, ভূমি দখলের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে, তা এ বিচারহীনতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

আরও পড়ুন

ভবিষ্যদ্বাণীর শিক্ষা: ঐক্যই শক্তি

১৯৭১ সালের পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক স্থায়ী চক্র বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কাঠামোগত বৈষম্য বেড়েছে। কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণী যেন এই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। ভূমি হারানো, অস্তিত্বের সংকট ও রাজনৈতিক বঞ্চনা যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বাস্তবতা।

তবু কুনো ব্যাঙের ভবিষ্যদ্বাণীতে যেমন বলা হয়েছে—এ রকম রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় ‘ছোটদের অস্তিত্ব শুধু রক্ষা পেতে পারে যদি তারা বড়দের কাছে আশ্রয় পায়’—তেমনি আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ, নাগরিক সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা অপরিহার্য। নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত হতে পারে।

  • মিলিন্দ মারমা আদিবাসী লেখক ও অধিকারকর্মী। ইমেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব