আর কত শ্রমিক পুড়লে–মরলে যথেষ্ট মনে হবে

আগুন লাগা পোশাক কারখানার সামনে স্বজনদের খোঁজ পেতে উদ্বেগাকুল মানুষ। ১৪ অক্টোবর। রাজধানীর মিরপুরেছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকা। একদিকে বিপজ্জনক রাসায়নিকের অবৈধ গুদাম, আরেক দিকে তালাবদ্ধ পোশাক কারখানা। যেন এক পাশে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন, আরেক পাশে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনস।

বিপজ্জনক রাসায়নিক আর তালাবদ্ধ কারখানার এ ঝুঁকিপূর্ণ সহাবস্থানে দুর্ঘটনা ছিল অনিবার্য। সেই অনিবার্য ঘটনাই ঘটল ১৪ অক্টোবর দুপুরে। এ সময় আলম ট্রেডার্সের রাসায়নিক গুদামে লাগা আগুন বিপরীত পাশের চারতলা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ছাদ তালাবদ্ধ থাকায় বিষাক্ত গ্যাস ও আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পোশাক কারখানার অন্তত ১৬ শ্রমিকের।

গণ–অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষ ও তাঁদের সন্তানেরা। তবে অভ্যুত্থানের পর তাঁদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বকেয়া মজুরি কিংবা কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের আগের মতো লাঠি–গুলি–কাঁদানে গ্যাস জুটেছে। এমনকি মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসেনি। তাঁরা আগের মতোই অনিরাপদ কর্মপরিবেশে অকালমৃত্যুবরণ করছেন।

বেসরকারি সংগঠন সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির হিসাবে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে কর্মস্থলে ৩৭৩টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪২২ শ্রমিক। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬৭ জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৪০, বজ্রপাতে ৫৬, ছাদ বা উঁচু স্থান থেকে পড়ে ২৩, আগুন ও বিস্ফোরণে ১২ ও অন্যান্য কারণে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২৪ জন।

পরিবহন, নির্মাণ, কৃষি বা কারখানায় আলাদা আলাদা ঘটনায় দু–একজন করে শ্রমিকের অকালমৃত্যু তেমন একটা মনোযোগ পায় না। বড় কোনো দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশিসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যুতে সংবাদমাধ্যমে কিছুদিন আলোচনা থাকে। তারপর আবার সব আগের মতোই চলতে থাকে। তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু শাস্তি বা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না। এভাবেই চলতে থাকে।

শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য শ্রম সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশ ছিল, প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। আমি দুর্ঘটনার পরদিন কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে খুঁজে দেখেছি, মিরপুরের রূপনগরের আর এন ফ্যাশন কিংবা স্মার্ট প্রিন্টিং নামের কারখানার পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়া যায় কি না। সেখানে কারখানা পরিদর্শনবিষয়ক বার্ষিক পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রতিবেদন থাকলেও কারখানা ধরে কোনো পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়া গেল না।

এ বিষয়ে সড়ক থেকে কর্মক্ষেত্র: বাংলাদেশে কাঠামোগত দুর্ঘটনা (২০২৪) বইয়ে লিখেছিলাম, ‘তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে হাশেম ফুড কারখানায় শ্রমিকের মৃত্যু হতো না, নিমতলীর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে চুড়িহাট্টায় প্রাণহানি এড়ানো যেত, বনানীর এফ আর টাওয়ারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া হলে বেইলি রোডের ঘটনা এড়ানো যেত। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে এই বিষয়টা পরিষ্কার যে অগ্নিকাণ্ড জীবন ও সম্পদহানি হওয়ার ঘটনাগুলো দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত সমস্যার ফলাফল এবং যত দিন এই কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করা না হবে, তত দিনই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে।’

আরও পড়ুন

গণ–অভ্যুত্থানের পরও এ কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবারও আবাসিক এলাকায় অবৈধ রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণ ঘটল। তালাবদ্ধ পোশাক কারখানায় রাসায়নিক আগুনে নির্মমভাবে পুড়ে মরা গেলেন ১৬ শ্রমিক। প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর সময়কাল এসব কাঠামোগত সমস্যা দূর করার জন্য যথেষ্ট কি না। এক বছরে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না হলেও অত্যন্ত সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেই এ রকম কিছু সুপারিশ আছে।

যেমন শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য শ্রম সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশ ছিল, প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। আমি দুর্ঘটনার পরদিন কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে খুঁজে দেখেছি, মিরপুরের রূপনগরের আর এন ফ্যাশন কিংবা স্মার্ট প্রিন্টিং নামের কারখানার পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়া যায় কি না। সেখানে কারখানা পরিদর্শনবিষয়ক বার্ষিক পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রতিবেদন থাকলেও কারখানা ধরে কোনো পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়া গেল না।

কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য পরিদর্শন প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিদর্শন প্রতিবেদনে খুব সুনির্দিষ্ট কিছু চেক লিস্ট থাকে। এই চেক লিস্ট ধরে পরিদর্শন করা হলে কারখানার নিরাপত্তার সব সমস্যাই উঠে আসার কথা। যেমন চেক লিস্টের একটি প্রশ্ন এ রকম—২০ জনের অধিক ব্যক্তির কর্মসংস্থানযুক্ত কক্ষসমূহে কমপক্ষে দুটি করে বহির্গমন পথ এবং ওই বহির্গমন পথ, চলাচলের পথ, সিঁড়ি ও মেঝেসমূহ যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিবন্ধকতামুক্ত রাখা হয় কি না। (ক্রমিক নং ৪খ.৩) চেকলিস্টে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও অগ্নিনিরাপত্তা সনদ নিয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা আছে।

নিহত শ্রমিকদের লাশ পাওয়া গেছে দোতলা ও তিনতলায়, যেখানে ছিল স্মার্ট প্রিন্টিং এবং আর এন ফ্যাশন নামের কারখানা দুটি। কারখানা ভবনের ছাদের দরজায় দুটি তালা লাগানো থাকায় শ্রমিকেরা কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। এ ছাড়া কারখানা ভবন ও রাসায়নিকের গুদাম কোনোটিরই অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে যদি কারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হতো, তাহলে শ্রমিকদের জন্য যথাযথ বহির্গমন পথ না থাকা বা অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থার সমস্যাগুলো ধরা পড়ার কথা এবং আইনি ব্যবস্থা নিয়ে মালিকপক্ষকে এসব গুরুতর নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান করতে বাধ্য করার কথা। বোঝাই যাচ্ছে এ কাজগুলো যথাযথভাবে হয়নি।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে এ পরিদর্শন রিপোর্ট যদি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হতো, তাহলে বোঝা যেত কারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়েছে কি না, পরিদর্শনের সময় কারখানার কর্মপরিবেশ কেমন ছিল, পরিদর্শনের পর কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না ইত্যাদি। সেই সঙ্গে কারখানা ভবনের নির্মাতা ও নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে পরিদর্শন কর্মকর্তাদের নাম–পরিচয়ও জানা যেত। এতে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিদর্শন কার্যক্রম পর্যন্ত শ্রমিকের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবহেলার জন্য দায়ী নির্মাতা, ভবনমালিক, অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ, পরিদর্শন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদান করা সহজ হতো। শ্রম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কি খুব কঠিন ছিল?

আমরা দেখলাম, অন্তর্বর্তী সরকার অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের জন্য আগের নিয়মেই মাত্র দুই লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিদের জন্য ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করল। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

    [email protected]