দীর্ঘ সময় ধরে বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সরকার কয়েক দফায় তাঁদের দাবি পূরণের আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু দাবি আর পূরণ করেনি।
তবে এবার বাড়িভাড়া ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা রীতিমতো তামাশার শামিল বলে মনে করছেন শিক্ষকেরা।
এমন এক দিনে বাড়িভাড়া ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, সেটি (৫ অক্টোবর) ছিল বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
জাতীয় শিক্ষক ফোরামের নেতারা বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক শিক্ষাডটকম)
কোনো কোনো শিক্ষক বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা করতে সরকার বেশ মজা পায়। যেখানে মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোর দাবি, সেখানে শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়ানো তো হয়ইনি, বরং বাড়ানো হয়েছে সাকল্যে মাত্র ৫০০ টাকা।
এতে শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ফেসবুক উত্তপ্ত হয়েছে শিক্ষকদের তির্যক মন্তব্যে।
আগের ঘোষণা অনুযায়ী, ১২ অক্টোবর থেকে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
ঢাকা পোস্টের সংবাদে বলা হয়, শিক্ষকদের ক্ষোভের মধ্যেই দাবি বিবেচনায় নিয়ে ৫ অক্টোবর রাতে বাড়িভাড়া মূল বেতনের ২০ শতাংশ, চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি ও কর্মচারীদের বোনাস ৭৫ শতাংশে উন্নীত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রস্তাব পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষকেরা যে তামাশার কথা বলেছেন, এটা নতুন নয়। বহু বছর ধরেই তাঁদের সঙ্গে তামাশা করে আসছে সরকার। নিচে কিছু বিষয় আলোচনা করে তামাশার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যেতে পারে।
দুর্বল বেতনকাঠামো
মাধ্যমিক স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের সময় মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা।
এর সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও বিশেষ প্রণোদনা ১ হাজার টাকা যুক্ত হয়।
আর মূল বেতন থেকে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের নামে ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। সব মিলে একজন সহকারী শিক্ষক বেতন পান ১৩ হাজার ৭৫০ টাকা।
কলেজের ক্ষেত্রে মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, এর সঙ্গে ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ ও বিশেষ প্রণোদনা অন্তত ১ হাজার যুক্ত হয়।
আর মূল বেতনের ১০ শতাংশ কেটে রাখা হয়। সব মিলে একজন প্রভাষক বেতন পান ২২ হাজার ৩০০ টাকা।
চাকরির অন্যান্য সুবিধা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়ার কথা থাকলেও দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে তা দেওয়া হয় না।
এখন কথা হচ্ছে, ঢাকা বা বিভাগীয় শহরে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের যে বেতন, প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষকেরও একই বেতন।
ঢাকা আর গ্রামে থাকা-খাওয়ার খরচ কি এক? তাহলে কোন যুক্তিতে একই বেতন নির্ধারিত হয়েছে? তা ছাড়া এই বেতনে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকের সংসার চলে কীভাবে, তা কি সরকার ভেবে দেখেছে?
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, শিক্ষকদের বেতনের টাকা তুলতেই হয় না। প্রাইভেট–বাণিজ্য করেই তাঁরা ভালো চলেন।
কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো এটা সত্য, কিন্তু ঢালাওভাবে শিক্ষকসমাজকে নিয়ে এমন মন্তব্য বেদনাদায়ক ও প্রহসনমূলক। কেননা, বেশির ভাগ শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর মতো অবস্থানে থাকেন না।
ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়িয়ে যতটা সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করেন, অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের সে সুযোগ নেই।
তাই আপনার বাসাবাড়ির পাশের প্রাইভেট পড়ানো কোনো শিক্ষকের জীবনযাত্রা দেখে গোটা শিক্ষকসমাজকে সেভাবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। মোটের ওপর বেশির ভাগ শিক্ষকের জীবন যাপন করতে হয় মানবেতর।
বাড়িভাড়া
সাধারণত সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে বাড়িভাড়া মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ। তবে অবস্থাগত কারণে তা বেড়ে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়।
এ ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শতাংশ হিসাবে বেতন দেওয়ার কোনো পদ্ধতিই নেই। তাঁদের সাকল্যে বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা। এবার ৫০০ টাকা বাড়ানোর পরিপত্র জারি হয়েছে।
বোনাস
দুটি ঈদে সাধারণত চাকরিজীবীরা মূল বেতনের সমান বোনাস পেয়ে থাকেন। তবে শিক্ষকেরা এত দিন পেতেন মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। গত কোরবানির ঈদ থেকে পাচ্ছেন মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বোনাস। এটা বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়।
আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টানা ২১ দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন শেষে ১ আগস্ট আমরণ অনশন শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা।
পরে অবশ্য সরকারের আশ্বাসে অনশন ভাঙেন তাঁরা। তবে সরকারের সেই আশ্বাসে কোনো বস্তু মেলেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় শিক্ষকেরা প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় শিক্ষকেরা তাঁদের দাবির পক্ষে আন্দোলন করেছেন। আর সরকার বারবার ছেলেভোলানোর মতো আশ্বাসের ‘লাঠি-লজেন্স’ হাতে ধরিয়ে শিক্ষকদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও শতভাগ উৎসব ভাতা বাড়ানোর দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক মহাসমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচি হয়।
পরে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষাসচিব ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১০ সদস্যের শিক্ষক প্রতিনিধিদলের বৈঠকে হয়।
দুই পক্ষের আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে শিক্ষক প্রতিনিধিদল মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসে।
সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়া বাড়ানো হলো ৫০০ টাকা, যা হাস্যকর ও ‘খয়রাতি’ বলে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।
সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো বলা হতে পারে, এটা তো বেসরকারি চাকরি, তাদের এত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এ কথা ধোপে টিকবে না এই জন্য যে ২০ বছর ধরে সরকার উদ্যোগী হয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ধাপে ধাপে যাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষকদের নিয়োগ দিচ্ছে।
সুতরাং এমপিওভুক্ত শিক্ষক ইস্যুতে সরকারের গা–ছাড়া ভাব দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
পোশাককর্মীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি কিংবা অষ্টম শ্রেণি পাস। আর শিক্ষকেরা স্নাতক পাস। অনার্স-মাস্টার্স পাস করে, এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসে অনেকে স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকদের এমন বেতনকাঠামো ও মূল্যায়নের বিষয়ে কী বলা যায়—বৈষম্য, প্রহসন, নাকি তামাশা! সবক্ষেত্রেই কম ও কাটছাঁট করে সরকার শিক্ষকতার চাকরিকে কার্যত প্রতিবন্ধী চাকরিতে রূপান্তর করেছে। স্বভাবতই শিক্ষকমহলে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা আর কত?
তৈরি পোশাক খাতে সর্বশেষ সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা (নতুন বা সহকারী কর্মীদের জন্য)। এটি ২০২৩ সালের শেষের দিকে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে।
মাস শেষে সব মিলে একজন পোশাককর্মী বেতন পান অন্তত ১৫ হাজার টাকা। অতিরিক্ত ডিউটি করলে তা পৌঁছে দাঁড়ায় ২০ হাজারে। সেখানে সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১৫ হাজার টাকার নিচে।
পোশাককর্মীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি কিংবা অষ্টম শ্রেণি পাস। আর শিক্ষকেরা স্নাতক পাস। অনার্স-মাস্টার্স পাস করে, এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসে অনেকে স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করছেন।
শিক্ষকদের এমন বেতনকাঠামো ও মূল্যায়নের বিষয়ে কী বলা যায়—বৈষম্য, প্রহসন, নাকি তামাশা! সবক্ষেত্রেই কম ও কাটছাঁট করে সরকার শিক্ষকতার চাকরিকে কার্যত প্রতিবন্ধী চাকরিতে রূপান্তর করেছে। স্বভাবতই শিক্ষকমহলে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা আর কত?
তৌহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব