মধুদের মৃত্যুতে তাঁরা ঘুমান কী করে

বারবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের দেশকে তুলনা না করে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফল রাষ্ট্রের একটি উদাহরণ কি হয়ে উঠতে পারে না বাংলাদেশ?
ফাইল ছবি

‘আমাদের ছোট মধু আকাশে উড়াল দিয়েছে। কোনো দোয়া, শুভকামনা আর চিকিৎসা ধরে রাখতে পারেনি ওকে।’ পাঁচ বছর বয়সী কন্যাসন্তান মধুর মৃত্যুর পর এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন মধুর বাবা।

পরদিন লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে মধুর শেষযাত্রার ছবি পোস্ট দিয়ে শোকাহত বাবা আবার লেখেন, ‘ওই আমার খুকুমণি যায়!’ মধু সম্প্রতি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে। ছোট্ট মধুর মৃত্যু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছে, শোকাহত করেছে সবাইকে। মধুকে অনেকেই চিনত। মধু ছবি আঁকত, বই পড়ত, গান গাইত। মধুর উজ্জ্বল শৈশব আমাদের স্বপ্ন দেখাত আলোকিত আগামীর। উজ্জ্বল সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ মধু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চিরতরে।

শুধু মধু নয়, ডেঙ্গু জ্বরের কাছে হার মেনে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে আরফিয়া আর সিয়ামের মতো আরও অনেক শিশু; যাদের নাম আমাদের অজানা। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। এই বছর ডেঙ্গুর নানা রেকর্ড বিগত সব বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়, আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বরের পর ডেঙ্গুর তীব্রতা কমে এলেও এ বছর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানতে পেরেছি, প্রতিবছর বিশ্বে ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় মশার কামড়ে। শুধু ম্যালেরিয়াতেই ৬ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, ৩৬ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে মারা যান। মশার কামড়ে পৃথিবীতে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ মৃত্যু হয় অন্যান্য প্রাণীর কারণে। সেই হিসেবে মশাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী বলা যেতে পারে। পৃথিবীতে যত মানুষ মারা গেছে, তার অর্ধেকই নাকি মশাবাহিত রোগে। অবাক করা এসব তথ্য জেনে রীতিমতো ভড়কে গেছি।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তো মশা নিয়ে এমন সব গবেষণা বা পড়ালেখা জানার কথা নয়। কিন্তু যাঁরা মশকনিধনের এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের কাছে তো এসব তথ্য অজানা থাকার কথা নয়। অবাক লাগে, এ ধরনের তথ্য জানার পরও আমাদের মশক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এত ঢিলেঢালা হয় কী করে! ছোট্ট মধু, আরফিয়া কিংবা সিয়ামের মৃত্যুর দায় নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা রাতে ঘুমান কী করে! এসব শিশুর মা-বাবার দীর্ঘশ্বাস কী তাঁদের ছুঁয়ে যায় না? তাঁরা কি কখনো স্বজনহারা এই পরিবারের মানুষগুলোর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার প্রয়োজনীয়তাটুকুও অনুভব করেন না?

পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের মৃত্যুর কারণ মশাবাহিত রোগ হলেও, বাংলাদেশের মশক প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় বিষয়টির গুরুত্ব তেমন অনুভূত হয় না। চারপাশের অপরিচ্ছন্নতা, জনগণের অসচেতনতা, চিকিৎসার অপ্রতুলতা, ডেঙ্গুর ধরন এবং উপসর্গের পরিবর্তন, শিশু ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষায়িত সেবার অব্যবস্থাপনাসহ সব মিলিয়ে জটিল আকার ধারণ করেছে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ঘনবসতিপূর্ণ ও অপরিচ্ছন্ন দেশের একটি। বাংলাদেশের মানুষের জীবন যেন মশার মতো একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অথচ ডেঙ্গু তো কোভিড মহামারির মতো হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া কোনো পরিস্থিতি নয়।

মশকনিধনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রীর ‘ফ্লাইটে করে মশার বাংলাদেশে আসা’র মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য মধু, আরফিয়া কিংবা সিয়ামের শোকসন্তপ্ত পরিবারের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অগুরুত্বপূর্ণ ও হাস্যকর করে তোলে

২০০০ সাল থেকেই ডেঙ্গু আমাদের বাস্তবতা। তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন আমাদের এত অনীহা, এত গাফিলতি? কেন ডেঙ্গু প্রতিরোধে পর্যাপ্ত বাজেট ও জনশক্তি নিয়োগ করা হয় না? অন্যদিকে যেটুকু বাজেট বরাদ্দ আছে, সেটিরও সুষ্ঠু ব্যয় নিয়ে আছে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে মশকনিধনের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয়ের বিস্তর ফারাকের বাস্তবতা। একদিকে মশকনিধনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও লোকবলের অভাব আর অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও সমন্বয়হীনতায় ঝুঁকির মুখে পড়েছে শহরাঞ্চলের মানুষ। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

মশকনিধনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রীর ‘ফ্লাইটে করে মশার বাংলাদেশে আসা’র মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য মধু, আরফিয়া কিংবা সিয়ামের শোকসন্তপ্ত পরিবারের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অগুরুত্বপূর্ণ ও হাস্যকর করে তোলে।

মশকনিধনের ছবি দেখতে দেখতে, আর মশকনিধনের গল্প শুনতে শুনতে আমরা আজ ক্লান্ত। ‘মশা মারতে কামান দাগানো’র মতো প্রবাদবাক্যের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে মনে হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাস্তবিকই কামান দাগানোর মতো ব্যাপক আয়োজন ভিন্ন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু সেই কামানের গোলাবারুদ খাঁটি হবে তো! সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা সেই কামান চালানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন তো!

আরও পড়ুন

বারবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের দেশকে তুলনা না করে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফল রাষ্ট্রের একটি উদাহরণ কি হয়ে উঠতে পারে না বাংলাদেশ, যেমনটি কোভিডের ক্ষেত্রে হয়েছিল? মশা প্রতিরোধের জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করা, পুরো দেশের জন্য বাস্তবিক সমন্বিত কর্মকৌশল প্রণয়ন করা এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

মধুরা আর কখনো ফিরে আসবে না, এটাই রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু মধুর মতো অন্যান্য শিশুকে বাঁচাতে হবে। ক্ষুদ্র মশার কাছে হার মেনে আমাদের শিশুরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। দুনিয়ায় আলো ছড়ানোর আগেই মধুরা আকাশের ধ্রুবতারা হয়ে যেতে পারে না। মধুরা বেঁচে থাক, মধুরা আলো ছড়াক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী। ইমেইল: [email protected]