বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কেন প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। এ বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে—১ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এখান থেকে প্রযুক্তি খাত বাদ দিলে শিক্ষার বাজেট দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি সংবাদ অনেকের নজরে এসে থাকবে। সংবাদে দেখানো হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় শিক্ষায় বরাদ্দ পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে দশম। বাংলাদেশের পেছনে আছে কেবল বারমুডা, হাইতি, মৌরিতানিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, মোনাকো, পাপুয়া নিউগিনি, সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। এসব দেশের বেশির ভাগই অতি দরিদ্র হিসেবে পরিচিত।

গত বছর বাজেট-পরবর্তী এক আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছিল, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জিডিপির শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে গড় বরাদ্দ ছিল ৪১টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে নিচ থেকে পঞ্চম। এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, টেকসই অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতকে কোন চোখে দেখা হয়।

উন্নয়নশীল থেকে যেসব দেশ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে অথবা হওয়ার পথে রয়েছে, তাদের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অনেক বেশি। জিডিপির সামান্য অংশ এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ রেখে কোনো দেশ উন্নত হয়েছে—এমন নজির নেই

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়, দেশে জ্ঞাননির্ভর ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষা বাজেট ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া দরকার। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও তা জিডিপির ২ শতাংশের মতো।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। শিক্ষা যেকোনো দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায় হলেও বাংলাদেশের বাজেট পরিকল্পনায় তার পুরোপুরি প্রতিফলন দেখা যায় না।

শিক্ষা বাজেটের একটি অংশ ব্যয় হয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও ঋণ প্রদানে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায়। এ ছাড়া আরেকটি অংশ ব্যয় হয় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন ও নির্মাণকাজে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকনির্দেশনা সেখানে থাকে না।

আরও পড়ুন

নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৫৮টি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৫টিই ভবন নির্মাণের। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কিংবা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের জন্য খরচের বিশেষ প্রস্তাব নেই। এ ছাড়া শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক রচনা ও শিখনসামগ্রী তৈরির জন্য যে অর্থ বরাদ্দ থাকে, তা একেবারেই নগণ্য।

উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে টাকা থাকা দরকার। কোভিডের সময় দুই বছর শিক্ষা প্রদান অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখনঘাটতি হয়েছে। কিন্তু তা পূরণের জন্য পরবর্তী সময়ে কার্যকর উদ্যোগ বা কর্মসূচি নেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে পূর্বাপর বিবেচনা না করে এমন প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ঠিকমতো কাজ করেনি। যেমন সাত থেকে আট বছর আগে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর দেওয়া হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো হয় নষ্ট হয়ে যায়, অথবা শিক্ষকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে থাকেন।

শিক্ষার মানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রকাশনা ও গবেষণাকাজে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য এই খাতে অর্থ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রকাশনা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিংয়েও ভূমিকা রাখে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ১২ হাজার ১৮৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজস্ব বাজেটের পরিমাণ ৬ হাজার ১০৯ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং উন্নয়ন বাজেট ৬ হাজার ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

উন্নয়ন বাজেট ব্যয় হয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো তৈরির জন্য এবং পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্মাণ, সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নয়নের ব্যাপারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিকল্পনায় কিংবা জাতীয় বাজেট পরিকল্পনায় গুরুত্ব পায় না।

শিক্ষাক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জগুলোও শনাক্ত করা জরুরি। যেমন প্রাথমিক পর্যায়েই শিক্ষার্থী ঝরে পড়া, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের কোচিং-টিউশনি করানো, উচ্চশিক্ষা শেষ করেও দক্ষতার অভাবে কাজ না পাওয়া—এগুলো কেবল শিক্ষার সমস্যা নয়, এর সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষাবিষয়ক এ ধরনের চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা এবং শিক্ষার পরিসর ও মান বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা থাকা দরকার। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো কিংবা রেমিট্যান্স বাড়ানোর ব্যাপারটিও শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এদিক থেকে কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিসিএস চাকরির মাধ্যমে প্রশাসন, পুলিশ কিংবা অন্য ক্ষেত্রগুলোয় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যেমন বেড়েছে, সে অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে যাওয়ার আগ্রহ বাড়েনি। মেধাবী ও উচ্চ প্রশিক্ষিতদের একটা বড় অংশ বিদেশে গিয়ে কাজ করছে। এসব ব্যাপারে এখনই সতর্ক হয়ে ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশ মেধাবীদের হারাবে। এর ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিকট ভবিষ্যতে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এর প্রভাব গিয়ে পড়বে জাতীয় উন্নয়নে।

উন্নয়নশীল থেকে যেসব দেশ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে অথবা হওয়ার পথে রয়েছে, তাদের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অনেক বেশি। জিডিপির সামান্য অংশ এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ রেখে কোনো দেশ উন্নত হয়েছে—এমন নজির নেই। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিকে মিলিয়ে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটা ঠিক, শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সম্পর্ক আছে। এ সম্পর্ক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও দেখানো সম্ভব। কিন্তু শিক্ষা খাতকে আলাদাভাবে বিবেচনা করে বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক