গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে

১৫ বছর ধরে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল আর সংগঠন মিলে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন।

এর ফলে হাসিনা সরকারের পতন হয় ও তিনি এবং তাঁর দলের কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ পরিবর্তন শুধু একটা সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং দীর্ঘ সময়ের ভয় ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সাহস, আশা ও গণতান্ত্রিক চেতনার একটি বড় জয় ছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের সফলতাকে শুধু নিজের নামে দাবি করতে শুরু করে। কেউ কেউ বলতে থাকে, তাদের কারণেই সরকার পতন ঘটেছে। তাই তারাই ভবিষ্যতে ক্ষমতার একমাত্র ভাগীদার।

আবার কিছু ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যারা আগে প্রকাশ্যে তেমন সক্রিয় ছিল না। এ ছাড়া কিছু নতুন দল, যারা আগে রাজনীতিতে খুব একটা পরিচিত ছিল না, তারাও হঠাৎ করে সামনে চলে এসেছে। তারা নিজেদের ‘নতুন শক্তি’, ‘ভিন্নধারার দল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তাদের আচরণে কখনো কখনো পুরোনো রাজনীতির কৌশলই দেখা যায়।

আরও পড়ুন

এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকলেও আন্দোলনের পর তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ করছে। এতে আন্দোলনের মূল চেতনা—জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন ধীরে ধীরে পেছনের দিকে চলে গেছে।

এ বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাই কি আবার ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে নতুন একধরনের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেবেন?

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট, ২০২৪
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ব ইতিহাস ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা

বিশ্ব ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, যাঁরা গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তাঁরাই অনেক সময় পরে হয়ে ওঠেন স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিস্ট। প্রথমে তাঁরা ‘উদ্ধারকারী নেতা’ হিসেবে আবির্ভূত হলেও পরে সেই জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করেন।

উদাহরণস্বরূপ, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে দেশটির স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর শাসনে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও পরে তিনি বিরোধী দলগুলোকে দমন করেন, কৃষকদের জমি দখল করেন এবং দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেন।

ইথিওপিয়ার মেলেস জেনাওয়িও একইভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে একদলীয় শাসন কায়েম করেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করেন।

ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ দরিদ্র জনগণের পক্ষে কথা বলে বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু পরে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরো আরও কঠোর শাসন চালু করেন; সেনাবাহিনী দিয়ে বিরোধীদের দমন করেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন।

আফ্রিকার উগান্ডায় ইয়োয়েরি মুসেভেনি একসময় ছিলেন দেশটির স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতা, যিনি জনগণের জন্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু এখন তিনি প্রায় চার দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন, বিরোধীদের দমন করছেন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন।

আরও পড়ুন

ইথিওপিয়ার মেলেস জেনাওয়িও একইভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে একদলীয় শাসন কায়েম করেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করেন।

এ বাস্তবতা কেবল বিদেশেই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসেও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের দমননীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে বন্দী করা হলে দেশের ছাত্র-জনতা তাঁর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ গড়ে তোলেন। এ ক্ষেত্রে মাওলানা ভাসানীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ইতিহাসে স্মরণীয়।

১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন এবং ভিন্নমতের জায়গা সংকুচিত করে দেন। এভাবে তিনি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে এসেও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথ বেছে নেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁর শাসনে একক ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। তিনি মনে করেন যে এই রাষ্ট্রে একমাত্র তাঁর নেতৃত্ব প্রশ্নাতীত।

১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন, সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন এবং ভিন্নমতের জায়গা সংকুচিত করে দেন। এভাবে তিনি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে এসেও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথ বেছে নেন।

জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে দেশটির স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক ছিলেন।
ছবি: রয়টার্স

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়—মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র-যুবকদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সেই ছাত্রনেতাদের একটি অংশ (বিশেষ করে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত) ভাবতে শুরু করেন, যেহেতু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন, সেহেতু তাঁরাই নতুন রাষ্ট্র গঠনের একমাত্র বৈধ দাবিদার। এদের একটি অংশ সমাজতন্ত্রের নামে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং নিজেদের ‘বিপ্লবের অগ্রদূত’ হিসেবে দাবি করে সহিংস ও উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

অনেক সময় জাসদের কর্মী ও সমর্থকেরা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের চেষ্টা করেন, যার ফলে একদিকে শেখ মুজিবের দুঃশাসন, অন্যদিকে জাসদের নামে ছাত্র-উগ্রবাদের ভয়ংকর রূপ—এই দুইয়ে মিলে দেশে বিশৃঙ্খলা, হতাশা ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে।

এসব দৃষ্টান্ত ও অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, গণ-আন্দোলনের চেতনা যতই মহান হোক না কেন, ক্ষমতায় যাওয়ার পর নেতাদের মনোজগৎ, চারপাশের চাটুকারি পরিবেশ আর ‘নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব’ বোধ—এসবের কারণে গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকারীরা স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেন।

কেন নেতাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে

গবেষক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মতে, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নেতাদের কারও কারও মনোজগতে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। কারণ, তাঁরা নিজেকে ‘জনগণের মুক্তিদাতা’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।

হানা আরেন্ডট তাঁর বই দ্য অরিজিনস অব টোটালিটারিয়ানিজম-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে নাৎসি জার্মানি ও স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন—দুই ভিন্ন আদর্শের হলেও—একই রকম কঠোর শাসনব্যবস্থায় রূপ নেয়।

এ দুই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, বিপ্লবের পর যাঁরা ক্ষমতায় আসেন, তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে সব ভিন্নমতকে বিপদ হিসেবে দেখতে শুরু করেন। এরপর তাঁরা চারপাশে শুধু নিজের কথা মানা লোকদের রাখেন, বিরোধীদের দমন করেন এবং এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করেন, যেখানে মানুষ আর কথা বলার বা প্রশ্ন করার সুযোগ পান না। একসময় তাঁরা গণতন্ত্রের বদলে এমন এক শাসন কায়েম করেন, যেখানে একজন বা একদলই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

হুগো চাভেজ
ফাইল ছবি

অনেক লেখক ও বিশ্লেষক দেখিয়েছেন, যখন কোনো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দল ক্ষমতায় আসে বা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে, তখন অনেক সময় তারা নিজেদের সব ধরনের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে মনে করে। তারা ভাবতে শুরু করে, তারাই সবচেয়ে সঠিক, তারাই দেশের একমাত্র নৈতিক প্রতিনিধি।

ভারতের লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ক্ষমতার আশপাশে থাকা দলগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহনশীলতা হারিয়ে নিজেদের বিশ্বাসই সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। আর এসব চিন্তাভাবনা থেকেই নেতারা ‘সাধারণ মানুষ’ থেকে ‘পবিত্র শাসকে’ রূপান্তরিত হন, যেখান থেকে ফ্যাসিবাদের শুরু।

জিমবার্ডো দেখিয়েছেন, সাধারণ কাউকে হঠাৎ করে ক্ষমতার ভূমিকায় বসালে তাঁরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেকে ওপরের স্তরে ভাবতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেন।

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ জিমবার্ডো ১৯৭১ সালে একটি বিখ্যাত গবেষণা করেন, যার নাম ‘স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট’। এ গবেষণায় কিছু ছাত্রকে ‘কারাবন্দী’ আর কিছু ছাত্রকে ‘গার্ড’ বা কারারক্ষীর ভূমিকা দেওয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা যায়, যাঁরা গার্ড ছিলেন, তাঁরা ক্ষমতা পেয়ে সহানুভূতিশূন্য ও নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করেন।

জিমবার্ডো দেখিয়েছেন, সাধারণ কাউকে হঠাৎ করে ক্ষমতার ভূমিকায় বসালে তাঁরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেকে ওপরের স্তরে ভাবতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলেন।

চলচ্চিত্র ও সাহিত্যেও বহুবার দেখানো হয়েছে, কীভাবে মানুষ বা দল গঠনমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেও ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে জার্মান চলচ্চিত্র দ্য ওয়েভ (২০০৮)-এর কথা বলা যায়। এতে দেখা যায়, একটি ক্লাসে এক শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের নিয়ে একটি নিয়মকানুন মেনে চলার দল তৈরি করেন। শুরুতে সবকিছু ভালো মনে হলেও পরে সেই দলের ছেলেরা এমন আচরণ করতে থাকে, যেন তারাই সবার চেয়ে ভালো আর যারা ভিন্নমত পোষণ করে, তাদের দমন করতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

একই রকম ঘটনা দেখা যায় জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস অ্যানিমেল ফার্ম-এ (১৯৪৫), যেখানে পশুরা মানুষকে তাড়িয়ে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, তারাই মানুষের মতো শোষক হয়ে উঠেছে। গল্পে বলা হয়েছিল, ‘সব পশু সমান, কিন্তু কেউ কেউ আরও বেশি সমান।’ এ কথা বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে ক্ষমতা পেলে কেউ কেউ নিজেকে সবার ওপরে মনে করতে শুরু করে।

এ রকম মনোভাবের ব্যাখ্যা দিতে মনোবিজ্ঞানী এরিখ ফ্রম তাঁর বই এসকেপ ফ্রম ফ্রিডমে (১৯৪১) বলেন, মানুষ স্বাধীনতা পেলেও অনেক সময় নিজের মনের ভেতরে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা লুকিয়ে রাখে। নিরাপত্তা আর নেতৃত্বের আশায় মানুষ তখন এমন একজনের ওপর নির্ভর করে, যিনি জোর করে সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যেই একদিন একনায়ক মনোভাব গড়ে ওঠে।

উগান্ডার স্বৈরশাসক ইউওয়েরি মুসেভেনি
ফাইল ছবি

কে হবে ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসক

এ প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির পটভূমি বলে, শুধু পুরোনো দল বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নয়, বরং নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব, সৎলোকের শাসন বা বৈষম্যহীন সমাজের দোহাই দিয়ে যে কেউ নিজেদের ‘জনগণের ভাষ্য’ দাবি করে আবার একনায়কতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারে।

বিএনপির কথাই ধরা যাক; ১৯৯১ সালে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেও দলটি অনেক রাজনৈতিক ভুল করেছে; এমনকি তারা ভোট চুরি ও দমননীতির অভিযোগ থেকেও মুক্ত নয়। তবে রাজনৈতিক কাঠামোর দিক থেকে বিচার করলে বিএনপির আদর্শগত কাঠামোয় ‘একক কর্তৃত্ববাদী শাসনের’ প্রবণতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। দলটি শুরু থেকেই একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের আলোকে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, যা জিয়াউর রহমানের প্রণীত ১৯ দফার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়।

এ ছাড়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, বিএনপির শাসনামলে অনেক অন্যায় ও ভুল হয়েছিল। অন্য অনেক রাজনৈতিক দলের তুলনায় বিএনপির অনেক সমর্থকও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতৃত্বের সমালোচনায় পিছপা হন না; যদিও এটিকে নিখুঁত গণতন্ত্র বলা যায় না, তবু ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতির বিপরীতে এটি কিছুটা আলাদা দৃষ্টান্ত।

আমরা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারি না, কে পরবর্তী শাসক হবেন। তবে এটুকু বলা যায়, গণতান্ত্রিক আদর্শ টিকিয়ে রাখতে হলে যে দলই ক্ষমতায় যাক, তাকে অবশ্যই সহনশীলতা, স্বচ্ছতা ও জনগণের কাছে জবাবদিহি বজায় রাখতে হবে; তা না হলে নতুন বা পুরোনো, যেকোনো দলই স্বৈরাচারী উঠতে পারে।

  • মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব