আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ
৭ নভেম্বর: ‘সিপাহি ইন্তিফাদা’ যে কারণে আজও প্রাসঙ্গিক
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায় একই ধরনের ‘ইন্তিফাদা’। দুটিই নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের অধরা স্বপ্নের পুনঃপুন বিস্ফোরণ। দুটিই উনসত্তর আর একাত্তরের ‘সিলসিলা’। ৭ নভেম্বর এখনো কেন প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ
১৯৭৫ সালের সিপাহি অভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। উপলক্ষটি অনেকটা নীরবেই পার হচ্ছে। ইতিহাস সচরাচর বিজয়ীরা লেখেন। পঁচাত্তরের সিপাহি সমাজ এবং তাঁদের নেতা আবু তাহেরের চিন্তা-চেতনাও তাই ক্রমে ধুলায় চাপা পড়ছে।
ওই অভ্যুত্থানের ইতিহাসের পূর্বাপর বেশ বিকৃতির শিকারও হয়েছে ইতিমধ্যে। অভ্যুত্থানের যুক্ত অনেকের পরবর্তীকালের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাও তার নৈতিক আবেদন কমিয়েছে। তবে বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের নির্মমতা হলো ঘুরেফিরে ৫০ বছর পরও তাকে সিপাহি অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার মুখোমুখি হতে হলো ২০২৪ সালে এসে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে অনেকটা একই ঘটনা ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থান এবং ৫০ বছর আগে সিপাহিদের চাওয়ার মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি নয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোই যেন আবু তাহেরদের চিন্তাকে আজ ও আগামীর বাংলাদেশের কাছে তুমুলভাবে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।
বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থানের গর্ভে সিপাহি অভ্যুত্থানের চৈতন্য
চব্বিশের লাল জুলাইয়ে শহীদদের মধ্যে বড় একাংশ ছিল শ্রমজীবী। শহীদ শিক্ষার্থীদের বড় অংশও প্রান্তিক জেলা থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ঢাকার যাত্রাবাড়ীকে বলা হয় জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ‘লেনিনগ্রাদ’। সেখানে শ্রমজীবী মানুষ রক্তের দেয়াল তুলে সশস্ত্র প্রতিবিপ্লবীদের থামিয়েছিল। প্রশ্ন তোলা যায়, কেন চব্বিশের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ডাকে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ‘শ্রমজীবী বাংলাদেশ’ রাজপথে নেমে এসেছিল?
এর উত্তর ইতিমধ্যে হাজার হাজার বার লেখা হয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান বাহুর প্রতিদিনের সন্ত্রাস থেকে মুক্তি চেয়েছিল নিচুতলার সমাজ। সে কারণে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায় একই ধরনের ‘ইন্তিফাদা’। দুটিই নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের অধরা স্বপ্নের পুনঃপুন বিস্ফোরণ। দুটিই উনসত্তর আর একাত্তরের ‘সিলসিলা’।
৫০ বছর আগে সিপাহিরাও চেয়েছিলেন ‘রাষ্ট্র মেরামত’ হোক, পাল্টাক। ১৭৯২ সালে কর্নওয়ালিশদের তৈরি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের জনগণতান্ত্রিক পুনর্গঠন চেয়েছিলেন তাঁরা। সেদিনের সিপাহিরা অনেকেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাহাত্তরে আবার তাঁরা একাত্তরের পরাজিত রাষ্ট্রকাঠামোকে ফেরত দেখতে চাননি; কিন্তু ঘটছিল তা–ই।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর সিপাহিদের মতোই চব্বিশের জীবিত শিক্ষার্থীদের অনেকেও এখন ঘরে ঘরে একধরনের ট্রমায় ভোগেন। কারণ, লাল জুলাইয়ের পরও একই রাজনীতি ও একই দানবীয় রাষ্ট্রযন্ত্রকেই সাময়িক বিরতির পর আবার চারপাশে দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। একই রাষ্ট্রের এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পুরোনো দৌড় আবার তথাকথিত নতুন রাজনীতিতে। পাশাপাশি এই অভ্যুত্থানকে ‘গোপন-গুপ্ত’ একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখিয়ে তার গৌরবটুকু কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও বেশ দ্রুত মাঠে হাজির হয়ে গেছে।
যুদ্ধোত্তর দিনগুলোতে অন্য সবার পাশাপাশি কৃষকের উর্দি পরা সন্তানেরাও দেখতে পান পুরোনো সচিব দল, পুরোনো থানা, পুরোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, পুরোনো উৎপাদনব্যবস্থা, নতজানু বিদেশনীতি ও লুটেরা এক রাজনীতি। বহু সহযোদ্ধাকে যুদ্ধে হারিয়ে বাড়ি ও ব্যারাকে ফেরা জীবিত যোদ্ধাদের পক্ষে এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। মুক্তিযুদ্ধ এই জওয়ানদের তত দিনে তীব্র রাজনৈতিক নাগরিক করে তুলেছিল— কেবল এই সামাজিক মনস্তত্ত্ব বুঝলেই ১৯৭৫ সালের সিপাহিদের বিপ্লবচেষ্টার দার্শনিক মর্মটুকু বুঝতে এককদম এগোতে পারব আমরা, না হলে আমরা কেবল তাদের ভুল দেখতে পাব।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর সিপাহিদের মতোই চব্বিশের জীবিত শিক্ষার্থীদের অনেকেও এখন ঘরে ঘরে একধরনের ট্রমায় ভোগেন। কারণ, লাল জুলাইয়ের পরও একই রাজনীতি ও একই দানবীয় রাষ্ট্রযন্ত্রকেই সাময়িক বিরতির পর আবার চারপাশে দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। একই রাষ্ট্রের এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পুরোনো দৌড় আবার তথাকথিত নতুন রাজনীতিতে। পাশাপাশি এই অভ্যুত্থানকে ‘গোপন-গুপ্ত’ একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখিয়ে তার গৌরবটুকু কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও বেশ দ্রুত মাঠে হাজির হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর গুলিবিদ্ধ আহত আবু তাহের বেজ হাসপাতাল থেকে ফিল্ডে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে শেষ লাইনে বলছিলেন, ‘মনে রেখো, একটি পবিত্র ইচ্ছা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছ তোমরা। বাংলাদেশ গড়ারও দায়িত্ব তোমাদের।’
মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পরের সিপাহি অভ্যুত্থান ছিল ওই ‘পবিত্র ইচ্ছা’র একরূপ প্রকাশ। ২০২৪ সালের লাল জুলাই কি অনুরূপ আরেক পবিত্র ইচ্ছারই প্রকাশ নয়?
মুক্তিযুদ্ধোত্তর আশাভঙ্গ ছাড়াও পঁচাত্তরের সিপাহি অভ্যুত্থানের ভিন্ন আরও দুটি পটভূমি চিহ্নিত করতে পারি আমরা। প্রথমত, তৎকালীন শাসকদের একদলীয় রাজনীতি, কুশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনের নির্মমতা ওই অভ্যুত্থানের মেজাজ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে কোরিয়া থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে পলিটিকো-মিলিটারি নেতৃত্বের সফলতা বাংলার উর্দি পরা কৃষক সন্তানদের ক্রমাগত একটি নতুন সমাজের স্বপ্নে উসকানি দিয়েছে। এরাই নভেম্বর অভ্যুত্থানের ‘সিপাহি’।
মাত্র চার বছর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁদের কমান্ডার নির্দেশ দিতেন: ‘কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিলে সকালে তাঁর বাড়ির কিছু কাজ করে দাও। যেদিন অপারেশন নেই, সেদিন তাঁর ধান কেটে দাও, খেত নিড়াও, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পদ্ধতি রপ্ত করো।’ উর্দি ও লাঙলের এ রকম মৈত্রীর ভেতর জন্ম নেওয়া মূল্যবোধসহ ব্যারাকে ফেরা জওয়ান ও কমান্ডারদের পক্ষে একাত্তর–পরবর্তী পরিবর্তনহীন গতানুগতিক বাংলাদেশ মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।
সিপাহি অভ্যুত্থানকে কলঙ্কিত করার বহু চেষ্টা এখনো কমবেশি চলমান। ফলে সেদিনের প্রকৃত ইতিহাস ও স্মৃতি রক্ষা করাই আজকের সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সিপাহিদের বহুল আলোচিত ‘১২ দফা’র প্রথম দফা ছিল এ রকম: ‘আমাদের বিপ্লব নেতা বদলের জন্য নয়, আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী। ধনীদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করা হয়েছে। …আমরা জনতার সঙ্গে থাকতে চাই। এই বিপ্লব গরিব শ্রেণির স্বার্থের জন্য।’
ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে বইছিল উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রাম এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের নানান অকুতোভয় প্রচেষ্টা। তার ঢেউ ‘প্রলোভন’ ছড়াচ্ছিল বাংলার দুই দিকেই। ১৯৭৫ সালের সিপাহি অভ্যুত্থান এবং আবু তাহের ও জিয়াউদ্দিনদের বুঝতে তাই তখনকার বৈশ্বিক বাস্তবতা বোঝাও জরুরি। আজকের বিশ্বে চারদিকে জেন-জি গণ–অভ্যুত্থানের যে সংক্রামক জোয়ার বইছে, ষাট ও সত্তরের দশকে তেমনই চলছিল সমতামুখী ঔপনিবেশিক জোয়ালমুক্তির লাগাতার চেষ্টা।
কিন্তু বাংলাদেশে তাহেরদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তার দায় নিয়ে তাহের মৃত্যুদণ্ড মেনে নিয়েছেন; কিন্তু সেই সময়ের আকাঙ্ক্ষাকে ফাঁসি দেওয়া সম্ভব হয়নি। হলে ২০১৮ সালে এসে কেন স্কুলের বাচ্চারা বলে উঠবে ‘এ রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে!’ এ কথা তো ষাট ও সত্তর দশকের কথা। এটা কোথায় পেল তারা? কে তাদের শিখিয়েছে? তার মানে সুদূর কাজলায় তাহেরের শেষশয্যায় সিপাহিদের চাওয়াগুলোও মাটিচাপা পড়েনি। হয়তো একইভাবে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার দর–কষাকষিতে চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের কোনো আকাঙ্ক্ষারই কবর রচিত হবে না।
নিম্নবর্গের ইতিহাস এভাবেই এগোয়। সে মরতে মরতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ইন্তিফাদা এগিয়ে নেয়। অনেক জেলায় এ রকম জনপদ তাই একদম বিরল নয়—যে ঠিকানায় একাত্তরের যোদ্ধা, পঁচাত্তরের সৈনিক আর চব্বিশের কোনো শিক্ষার্থীর শেষ বিশ্রামের ঠাঁই হয়েছে।
দেশের কাঠামোগত সমস্যা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন সিপাহিরা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কাঠামোতে সিপাহিরা অতি নিচুতলার এক বর্গ। ফলে খুব সংগত কারণে পরবর্তীকালে ইতিহাসচর্চায় বহুজন ১৯৭৫ সালের নভেম্বর অভ্যুত্থানের গৌরবটুকু কেড়ে নিয়ে একে প্রতিক্রিয়াশীল এবং দেশবিরোধী উদ্যোগ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সিপাহি অভ্যুত্থানকে কলঙ্কিত করার বহু চেষ্টা এখনো কমবেশি চলমান। ফলে সেদিনের প্রকৃত ইতিহাস ও স্মৃতি রক্ষা করাই আজকের সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
সিপাহিদের বহুল আলোচিত ‘১২ দফা’র প্রথম দফা ছিল এ রকম: ‘আমাদের বিপ্লব নেতা বদলের জন্য নয়, আমরা ছিলাম ধনীদের বাহিনী। ধনীদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করা হয়েছে। …আমরা জনতার সঙ্গে থাকতে চাই। এই বিপ্লব গরিব শ্রেণির স্বার্থের জন্য।’
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা ছিল রাজবন্দীদের মুক্তি ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মতামত নেওয়ার দাবিতে। ‘ব্রিটিশ আইনকানুন বদলের’ দাবিও ছিল ছোট্ট ওই লিফলেটে।
ওই ‘১২ দফা’য় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কোনো অভিলাষ ছিল না। এই অভিলাষ না থাকা ভুল না শুদ্ধ, সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু ক্ষমতালিপ্সার ঊর্ধ্বে তাতে বরং ছিল স্পষ্ট এক রাজনীতি। এটি এক অদ্ভুত মিল, ২০২৪ সালেও এ দেশের সশস্ত্র বাহিনী জনতার সঙ্গে থাকার পক্ষেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। এবারও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী রাজনীতিবিদদের প্রধান অভিভাবক ভেবেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে বারবার এ রকম অবস্থা কেন হয়? ভবিষ্যতে এ রকম অবস্থা কীভাবে এড়ানো যাবে? ১৯৭৫ এবং ১৯৯০–এর মতো ২০২৪ সালেও জনতার মুখোমুখি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে নিজেদের ঘুরিয়ে জনতার পাশে দাঁড় করানোর যে অধ্যায়গুলো সশস্ত্র বাহিনী পার করেছে, তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের জন্য অনেক শিক্ষাও তুলে ধরছে। সেসব থেকে বাংলাদেশ কি সংস্কারমূলক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে? ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর পুরোনো সংকটগুলো চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজতে না পারলে বারবার অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শহীদি কাফেলার আয়তনই কেবল বাড়বে।
৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আবু তাহেররা জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর মৈত্রীর জরুরি কর্তব্যের কথা ভেবেছিলেন। একাত্তর–পরবর্তী সময়ে ৪৪ ব্রিগেড থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসের আশপাশের গ্রামগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে সৈনিকদের কাঠামোগতভাবে শামিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় বন্যার ত্রাণ থেকে অবকাঠামো উন্নয়ন পর্যন্ত নানান উদ্যোগের দায়িত্ব নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীগুলো সে-ই ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। তারা জনবিচ্ছিন্ন গ্যারিসনে আটকে থাকতে চায়নি বলেই ইঙ্গিত মিলেছে।
নিঃসন্দেহে তাহেরদের চিন্তায় প্রতিরক্ষাকাঠামোয় সৈনিক-জনতার আরও বেশি মৈত্রীর স্বপ্ন ছিল। তারা দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার ভেতর জনতাকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এ রকম বাহিনীকে কোনো একনায়ক শেষমেশ জনতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে না। আবার নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিরক্ষা ভাবনার দিক থেকেও সেটি আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
নভেম্বর অভ্যুত্থান ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যে কর্নওয়ালিশতন্ত্রের বিরুদ্ধে একই পরিবর্তন চেষ্টার ধারাবাহিক দুটি ধরন মাত্র, সেই উপলব্ধিকে কখনোই রাজনৈতিক সাহিত্যে পাব না আমরা। এর মধ্যে তাহের অধ্যায়ের নৈতিক গৌরব এখানে—তিনি দ্রুত নিজের সীমাবদ্ধতার দায় নিজে বহন করেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। হয়তো এই নৈতিক শক্তির জোরেই ইতিহাস তাঁকে মুক্তি দেবে।
ছোট অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের টানাপোড়েনের মাঝখানে কতটা আর নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারবে; যদি না পুরো জনগোষ্ঠীকে তাতে যুক্ত করা যায়। আবার জাতীয় উন্নয়ন ধারায় সশস্ত্র বাহিনীকে যত বেশি সম্পৃক্ত করা যাবে, তত দেশজুড়ে কাঠামোগত ঐক্য তৈরি হবে।
মর্মের দিক থেকে এসবই ছিল ৫০ বছর আগের সিপাহিদের কেন্দ্রীয় ভাবাদর্শ। তাঁরা বাংলাদেশে সবাইকে যুক্ত করে নতুন এক জাতীয় উৎপাদন উদ্যোগ ও উৎপাদন সম্পর্কের কথা ভেবেছেন, যা আমাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কিছু অতিচেনা সমস্যা থেকে রেহাই দিতে পারত।
সৈনিকেরা ভুল ভেবেছিলেন কি? ২০২৪ সালেও আমাদের তো একই সমস্যার মুখেই দাঁড়াতে হয়েছে এবং আমরা ভেবেছি, এগুলো কিছু ব্যক্তির সমস্যা, লোভজনিত সমস্যা। তাঁদের বিচার করলেই সমাজ ও রাষ্ট্র সহিহ-শুদ্ধ হয়ে যাবে। এগুলো যে আসলে রাষ্ট্রের গঠনজনিত দায়, সেটি এবারও এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা।
এ রাষ্ট্র একই দেশের মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। শাসকেরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন যন্ত্রকে যে এভাবে ব্যবহার করতে পারে, সেটিই বন্ধ করতে চেয়েছিল পঁচাত্তরে সৈনিক সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের পরপর সিপাহিরা এসব শনাক্ত করতে হিম্মত রাখতেন। কারণ, পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো দেখে সমস্যাটা আঁচ করেছিলেন তাঁরা। সমকালীন তারকা কমিশনগুলো কিন্তু সেই সক্ষমতা দেখাতে পারল না—শিক্ষার্থীরা যাঁদের ওপর ভরসা রেখেছিলেন।
তাহের ও তাঁর সৈনিক সহযোদ্ধারাও একইভাবে ভেবেছিলেন, জাসদ পরিবর্তনের পাটাতন হবে। সৈনিকেরা পরিবর্তনের ব্যবহারিক সমাধান হাজির করার দায়িত্বে ডেকেছিলেন রাজনীতিবিদদের। কিন্তু সেই রাজনীতিবিদেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, তাতে সৈনিক-জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং এই উভয়ের যৌথ সৃজন ক্ষমতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার কলাকৌশল জানতেন না। রাজনীতিবিদদের সেই ব্যর্থতার দায় শোধ করতে হয়েছে হতবিহ্বল সৈনিকদের।
চব্বিশের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এখানে এসে আবু তাহেরদের ব্যর্থতা শনাক্ত করা যায়। ১৯৯০ সালেও ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক অপরিপক্বতার একই নজির রেখে এসেছেন ইতিহাসে।
তিন মুহূর্তেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে, সামাজিক সম্পর্কের রূপান্তর নয়। রাষ্ট্রের চূড়ায় কর্নওয়ালিশের সিলমোহর রয়েই গেছে। এটা তাই অস্বাভাবিক নয়, ১৯৭৫ সালের সৈনিক অভ্যুত্থানের মতোই চব্বিশের লাল জুলাইয়ের ইতিহাসও ভবিষ্যতে বিকৃতির মুখে পড়বে। এর বৈপ্লবিক নির্যাসটুকু আড়াল করে উভয় অধ্যায়কে স্রেফ সহিংস তৎপরতা বা রোমান্টিক গুপ্ত রাজনীতি আকারে দেখানোর চেষ্টা হবে।
নভেম্বর অভ্যুত্থান ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যে কর্নওয়ালিশতন্ত্রের বিরুদ্ধে একই পরিবর্তন চেষ্টার ধারাবাহিক দুটি ধরন মাত্র, সেই উপলব্ধিকে কখনোই রাজনৈতিক সাহিত্যে পাব না আমরা। এর মধ্যে তাহের অধ্যায়ের নৈতিক গৌরব এখানে—তিনি দ্রুত নিজের সীমাবদ্ধতার দায় নিজে বহন করেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। হয়তো এই নৈতিক শক্তির জোরেই ইতিহাস তাঁকে মুক্তি দেবে।
কিন্তু বাংলাদেশিরা সেই ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হবে কবে, যেখানে ব্রিটিশরা তাদের রেখে গেছে? সেই উৎপাদন সম্পর্ক কবে বদলাবে, যেখানে ৫৪ বছর পরও পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে? ৫০ বছর আগে একদিন কৃষকের একদল উর্দি পরা সন্তান কেবল এ রকম প্রশ্নগুলোই তুলেছিলেন। আজ সেই ৭ নভেম্বর।
আলতাফ পারভেজ গবেষক ও লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব
