ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে

প্রাণ বাঁচাতে ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে মানুষ
ছবি: এএফপি

২৪ ফেব্রুয়ারির হিম শীতল উষার প্রহরে কিয়েভের অধিবাসীদের ভোরের প্রার্থনায় দাঁড়ানোর কিংবা ঘুম থেকে উঠে সকাল সকাল কাজে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ মানুষগুলোকে কিয়েভ থেকে, এমনকি খোদ স্বদেশ থেকেই পালিয়ে পোল্যান্ডে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হয়েছে।

ইতিহাসের কী নির্মম পুনরাবৃত্তি! প্রায় ৮১ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪১ সালে হিটলার বাহিনী কিয়েভ আক্রমণ করেছিল এমনই এক ভোরে। পৃথিবীর সব স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদীর সামরিক ভাষা যেন অভিন্ন। যুদ্ধ ও আগ্রাসনের মুখে পড়ে পালানোর ইতিহাসও যেন ঘুরে ফিরে আসে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ পালিয়েছে ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে। ফিলিস্তিনের দেশহীন ঘরহীন মানুষের রক্তাক্ত ইতিহাস ৭৫ বছরের। ষাটের দশকে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছিল ভিয়েতনামের মানুষকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়েছে মানুষ। যশোর রোডই যেন পৃথিবীর পৌনঃপুনিক ইতিহাস। ২০০৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ পালিয়েছে ইউরোপে। মানব ইতিহাসের দুই সমৃদ্ধ নগর বাগদাদ ও দামেস্কও সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ থাকেনি গত দুই দশকে। এই চক্রের শেষে নতুন করে ইউরোপের মানুষের দিগ্‌বিদিক ছুটে চলার নতুন ইতিহাসের শুরু হলো।

আরও পড়ুন

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনে বিভিন্ন মহাদেশে ক্ষমতাবান পরাশক্তিগুলোর দুর্বল প্রতিবেশী দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে বাঁচার অধিকার সংকুচিত হওয়ার বিরাট আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। আটলান্টিকের দুই তীর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দুই তীরে, পশ্চিম থেকে পুবে ভূরাজনীতি ও বাণিজ্যযুদ্ধের যে আগমনী দামামা, তাতে নতুন দুশ্চিন্তা শুধু বাড়ন্তই।

স্বৈরাচারশাসিত মেরুগুলো ছোট দেশগুলোর ওপর বহুপক্ষীয় সাম্যের বদলে এককেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তারে নীতি ও বলপ্রয়োগের মাত্রা তীব্র করতে পারে। তাই ছোট দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা, ভবিষ্যৎমুখী সামরিক কৌশল, অর্থনীতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে তাই আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নাগরিকের অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বচ্ছ সুশাসন, মানবাধিকার ও টেকসই গণতন্ত্র।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে এমন যৌক্তিক এবং সুচিন্তিত পথে হাঁটতে হবে, যাতে পরাশক্তিগুলো কোনোভাবেই প্রভাব বিস্তার করার কিংবা পলিসিগত অনুপ্রবেশের ন্যূনতম খুঁত খুঁজে না পায়!

দীর্ঘমেয়াদি দুশ্চিন্তার পাশাপাশি ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনের এই যুদ্ধ বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ—উভয়ের জন্যই নতুন কিছু সমস্যা তৈরি করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের হাতে একটা ভালো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলেও তার কাছে স্থানীয় মুদ্রার রাজস্ব অর্থাৎ টাকার জোগানে বিশাল ঘাটতি আছে। অর্থাৎ সরকার এমনিতেই টাকার খোঁজে দিশেহারা ছিল, সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

আরও পড়ুন

১.

দেশের চলমান ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটের ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকাই ঘাটতির (৩৫ শতাংশ) মুখে আছে। এদিকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার অতি উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে মোট ঘাটতি প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ৪১ হাজার কোটি টাকা।
অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির পর জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে বলে অর্থনীতিতে নতুন একটা স্থবিরতা কাজ করতে পারে।

এমনিতেই নির্মাণসামগ্রীর দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প বা এডিপি বাস্তবায়নের গতি কমে গেছে। ফলে এসব খাত থেকে ভ্যাট ও শুল্ক কমে যাওয়ায় রাজস্ব আয়ে প্রভাব পড়েছে। যুদ্ধের ফলে স্থবিরতাটা আরও বাড়বে, এতে সরকারের রাজস্ব আয় আরও কমে যেতে পারে। আর রাজস্ব কমার অর্থই হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ঋণ, ব্যাংকঋণসহ বৈদেশিক ঋণের প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা বাড়া, যেহেতু সরকারের জনপ্রশাসন খরচ, উন্নয়ন খরচ, ভর্তুকি খরচ এবং যাবতীয় অপখরচ কমছে না।

২.

আমরা দেখেছি শুধু তিনটা (বুলেট ট্রেন, এক্সপ্রেসওয়ে, সাবওয়ে) মেগা প্রকল্পের ব্যর্থ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হয়েছে ৫৩০ কোটি টাকা। সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরতা ও অদক্ষতাজনিত অপখরচ এতই লাগামহীন যে ৩৪টি প্রকল্পের খরচ ৫৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩০ হাজার ৪৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

এই অর্থ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশি। সরকারের এমন ৩৪ উন্নয়ন প্রকল্প সংশোধন করার ফলে যে ব্যয় বাড়ছে, ওই টাকায় অন্তত দুটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ২০২১-২২ অর্থবছরের দশম সভায় (২২-০২-২০২২) এসব ব্যয় বৃদ্ধি অনুমোদিত হয়েছে।

পত্রিকার মূল বাস্কেটগুলো হিসাব করে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত গড় মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সমস্যা হচ্ছে বর্তমান মূল্যস্ফীতি এত বেশি যে এই বৃদ্ধিতেও কাজ হবে না হয়তো। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্ধিত আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব। ফলে সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ আরও বাড়াতে হবে। অর্থাৎ টাকার জোগানের জন্য স্থানীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকার জন্য সরকারের হাহাকার আরও বাড়বে। এটা করতে গিয়ে তার বৈদেশিক মুদ্রা খরচের ওপর চাপ পড়বে, এতে রিজার্ভ দ্রুত কমতে শুরু করতে পারে। অন্যদিকে টাকার মান ধরে রাখতে সরকারকে বাজারে বেশি ডলার ছাড়তে হবে, না হয় টাকার অবনমন করতে দিতে হবে।

৩.
সরকার গত ১১ বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিয়েছে। শুধু গত এক বছরে ১১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, এটা সরাসরি কৃষি ভর্তুকির (৯৫০০ কোটি) চেয়েও বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও সরকার ৫টি (সামিট নারায়ণগঞ্জ, কেপিসিএল-২ ও ৩, ওরিয়ন মেঘনাঘাট, ডাচ্‌–বাংলা পাওয়ার) কুইক রেন্টাল নবায়ন করেছে গত কয়েক মাসে। ইউক্রেন আগ্রাসনের ফলে, তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায়, বিদ্যুৎ খাতে সম্মিলিত ভর্তুকি বাড়াতে হবে, সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জের অপখরচ তো আছেই। এতে সরকারের রক্তক্ষরণ শুরু হবে, যদি না তারা পছন্দের লোকদের স্বার্থের অনুকূলে নবায়ন করা অপ্রয়োজনীয় চুক্তিগুলো বন্ধ না করে।

৪.

রাশিয়ার ওপর ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নিষেধাজ্ঞায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে হয়তো সমস্যা হবে না, যেহেতু রিঅ্যাক্টরসহ সবকিছু মোটামুটি পৌঁছে গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন এবং পরিচালনায় সমস্যা হতে পারে। তবে মূল সমস্যাটা হবে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ এগিয়ে নেওয়ার বেলায়। রাশিয়ার ওপর চিপ রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে ভেস্তে যেতে পারে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ প্রকল্পও।

৫.

যুদ্ধের ফলে গম ও ভুট্টার দাম বাড়বে। ফলে সাধারণ খাদ্য ও গোখাদ্যের আমদানি মূল্য বেড়ে সার্বিক খাদ্য আমদানি খরচ বাড়বে। বিশ্বের কিছু অঞ্চলে ‘এয়ার স্পেস’ ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা এসেছে বলে সমুদ্রের জাহাজজট এবং জাহাজভাড়া আবারও বাড়তে পারে, এটা বাংলাদেশের চলমান ভোজ্যতেলের সংকটকেও আরও বাড়াতে পারে। সব মিলে তেল–গ্যাস, নির্মাণসামগ্রীর কাঁচামালসহ খাদ্যমূল্য এবং ভোজ্যতেলের দাম আরও বাড়লে সরকারের রাজস্ব আয় এবং জনজীবনে আরও বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে।

যুদ্ধ স্থানীয় হলেও তার অভিশাপ বিশ্বব্যাপী। এমতাবস্থায় সরকারকে অপখরচের লাগাম থামিয়ে, দ্রব্যমূল্য কমাতে শুল্ক কমানোর ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। শুল্ক কমাতে গেলে যেহেতু রাজস্ব আরও কমে, বাজেটের ঘাটতি আরও বাড়বে, তাই একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা আনতে হবে, অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধি ও অপব্যয় দুটোই থামাতে হবে। অন্যথায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ জ্বালানি মূল্য, কঠিনতর আন্তর্জাতিক সরবরাহ পরিস্থিতি অর্থনীতিতে অযাচিত বিভীষিকা তৈরি করতে পারে। সাধু সাবধান!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
[email protected]