ইউরোপ যুক্তিতে পিছিয়ে পড়েছে

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ

শেষমেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মন্দা কাটিয়ে উঠছে বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত সে রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলের শেষের দিকে সে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়েছিল, এর অভিঘাত সারা দুনিয়াতেই অনুভূত হয়েছে। কিন্তু নিরাময় হিসেবে এটা খুব কার্যকর কিছু নয়। খুব বেশি হলে বলা যায়, অর্থনীতির যে স্থানে থাকার কথা আর সে যেখানে আছে, তার মধ্যকার পার্থক্যটা আর বাড়ছে না। আর সে পার্থক্য যদি কমার দিকে থাকে, তাহলে তার গতি খুব ধীর। এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে।
তারপর এটা আরও খারাপ হতে পারে। আটলান্টিকের অপর পারে খুব ভদ্রগোছের মার্কিন স্টাইলের পুনরুত্থানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে: সংকট না হলে ইউরোপ যেখানে থাকত আর এখন সে যেখানে আছে, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছে। অধিকাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে সংকটের আগের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে বেশি। যে পাঁচ বছরের কথা আমরা বিস্মৃত হতে চেয়েছিলাম, তা এখন পূর্ণ দশকে মোড় নিচ্ছে। শীতল পরিসংখ্যানের পেছনে জীবন ধ্বংস হচ্ছে, স্বপ্ন ধূলিসাৎ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে স্থবিরতা ও মন্দা চলার কারণে পরিবারগুলো ভেঙে পড়ছে বা মানুষ পরিবার গঠনেও উৎসাহী হচ্ছে না।
কিন্তু ইউরোপ এর শিকার হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। হ্যাঁ, এটা সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতির ভুল ব্যবস্থাপনা করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয় যে তারা কোনোভাবে এই বৈশ্বিক দুর্যোগের ভারটা ইউরোপের কাঁধে চড়িয়ে দিয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে অসুস্থতায় ভুগছে, সেটা তার নিজের সৃষ্ট। ধারাবাহিকভাবে বাজে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তার এ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, যেটা শুরু হয়েছে আসলে ইউরো দিয়ে। এটা ইউরোপকে একত্র করতে চেয়েছিল। কিন্তু আদতে এই ইউরো তাকে আরও বিভক্ত করেছে। একটি অভিন্ন মুদ্রা কার্যকর করতে যে প্রতিষ্ঠান গড়া দরকার, সেটা করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকায় যে ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, তা আর পূরণ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তার আংশিক কারণ হচ্ছে, দীর্ঘদিনের আস্থাহীন বাজারব্যবস্থায় ইউরোপের আস্থা স্থাপন, যেখানে তথ্যের অসম্পূর্ণতা নেই, তবে প্রতিযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। অধিক আত্মবিশ্বাস অনেক ক্ষতি করেছে। বছরের পর বছর ধরে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা তাঁদের নীতির ফলাফল নিয়ে যে ধারাবাহিকভাবে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন, তার ব্যাখ্যা আর কী-ই বা হতে পারে?
ব্যাপারটা এমন নয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এসব নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সমস্যা হচ্ছে, যে মডেলের ওপর ভিত্তি করে এসব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেগুলো খুবই ভুল ছিল। যেমন, গ্রিসের কথাই ধরুন। সে দেশের ঋণের বোঝা কমাতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তাতে সেই বোঝা ২০১০ সালের তুলনায় আরও বেড়েছে। রাজস্ব খাতের কট্টর নীতির কারণে সে দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত বেড়েছে। যা হোক, অন্তত আইএমএফ এসব বৃদ্ধিবৃত্তিক ও নীতিগত ব্যর্থতার দায় খোলাখুলি স্বীকার করেছে।
ইউরোপীয় নেতারা এ বিষয়ে নিশ্চিত যে কাঠামোগত সংস্কারই তাঁদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু যেসব সমস্যার কথা তাঁরা বলছেন, সংকটের আগের বছরগুলোতে সেগুলো দৃশ্যমানই ছিল। সে সময় তাঁরা প্রবৃদ্ধি থামানোর চেষ্টা করেননি। সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার কাঠামোগত সংস্কার নয়, ইউরোপের দরকার হচ্ছে ইউরোজোনেরই সংস্কার। তাদের কট্টর নীতি ছাড়তে হবে। বছরের পর বছর ধরে এই নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে পারেনি।
যারা ভেবেছিলেন ইউরো টিকবে না, তারা বারবারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সমালোচকেরা একটি ব্যাপারে খুবই ঠিক কথা বলেছে: ইউরোজোনের কাঠামো সংস্কার করা না গেলে বা কট্টর নীতি ছাড়তে না পারলে ইউরোপ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
ইউরোপের নাটক এখনো শেষ হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তি হচ্ছে, এর গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। কিন্তু ইউরো সেখানকার নাগরিকদের অর্থনীতির নিয়তি-বিষয়ক কথা বলার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে, বিশেষ করে সংকটগ্রস্ত দেশগুলোতে এটা ঘটেছে। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিতে হতাশ হয়ে বিভিন্ন দেশে ভোটাররা নির্বাচিত সরকারকে ছুড়ে ফেলেছে। কিন্তু নতুন সরকার এসে শুধু ব্রাসেলস, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও বার্লিনের নির্দেশিত পথেই হেঁটেছে।
কিন্তু এটা আর কত দিন চলবে? ভোটাররাও কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? ইউরোপজুড়েই এখন উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের উত্থান আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা আলোকায়নের মূল্যবোধের বিরোধিতা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যে আলোকায়নের কারণেই ইউরোপের এত সফলতা। কিছু কিছু জায়গায় বড় বড় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও গড়ে উঠছে।
এখন গ্রিস ইউরোপকে আরেক পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে। সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রিসে যে পতন শুরু হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার চেয়েও ভয়াবহ। তরুণদের বেকারত্ব ৫০ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিস সামারাসের সরকারের পতন ঘটেছে। আর সংসদের নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় জানুয়ারির ২৫ তারিখে সেখানে নির্ধারিত সময়ের আগেভাগেই একটি সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
বামপন্থী বিরোধী দল সিরিজা পার্টি মতামত জরিপে এগিয়ে আছে। তারা গ্রিসের বেইল আউটের শর্তাবলি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পুনরায় নির্ধারণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা জিতে যদি ক্ষমতা গ্রহণ না করে, তাহলে তার প্রধান কারণ হবে ভীতি: ইউরো এতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেই ভীতি। ভীতি কোনো মহান আবেগ নয়। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রিসের যে জাতীয় মতৈক্য দরকার, সে ধরনের কিছু এতে সৃষ্টি হবে না। ব্যাপারটা গ্রিস নয়, ব্যাপারটা হচ্ছে ইউরোপ। ইউরোপ তার গতিপথ না বদলালে মানুষের খেপে ওঠা অবশ্যম্ভাবী, যদি তারা ইউরোজোন সংস্কার ও কট্টরপন্থা ত্যাগ না করে। গ্রিস হয়তো এ পথে শেষ পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক পাগলামি চিরকাল চলতে পারে না। গণতন্ত্র এটা অনুমোদন করবে না। কিন্তু যুক্তি-বুদ্ধি পুনরুদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউরোপকে আর কত বেদনা সহ্য করতে হবে?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ।