উপমহাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও তার এক প্রতিনিধি

একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন কমিউনিস্টরা।
ছবি: রয়টার্স

প্রতিষ্ঠার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর অতিক্রান্ত হলো। ঘটনাবহুল এই সময়ে ভারতের কমিউনিস্টদের ভূমিকা উপমহাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। ১০০ বছরব্যাপী সময়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে কমিউনিস্টদের যেমন ব্যাপ্তি ঘটেছে, তেমনি এই সময়ের মধ্যেই কমিউনিস্ট ভাবধারার সংকটকেও আমরা তীব্র হতে দেখেছি।


ভারতের জাতীয় আন্দোলনে কমিউনিস্টদের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, সেই গৌরবের উত্তরাধিকার স্বাধীন ভারতে যেমন কমিউনিস্টরা বহন করেছেন, তেমনি দেশভাগের অব্যবহিত পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজ বপন হয়েছিল। তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টরা শোষিত মানুষের মুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির পরাকাষ্ঠা নির্মাণ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তেভাগা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের তৈরি ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণকেই আরও প্রত্যয়ীভাবে স্থাপন করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

মধ্যবিত্তের বুদ্ধিদীপ্ত বিভাষাকে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনতার মুক্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করতে মুজফফর আহমদ বাংলার বুকে কাজী নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কিছু আগেই বাংলার নবজাগরণের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করেছিলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে। বস্তুত গত শতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম সাহিত্য সমাজ, ‘শিখা’ পত্রিকা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন—এই যে দ্বিতীয় জাগরণ, তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছিলেন কমিউনিস্ট মুজফফর আহমদের মতো মানুষেরা। রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে সংস্কৃতি যে বিরাট ভূমিকা পালন করে, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা প্রথম দেখিয়েছিলেন কমিউনিস্টরাই। প্রতিষ্ঠালগ্নের অল্প সময় পরেই ভারতের রাজনীতিতে ধর্মান্ধতার প্রকোপ একটা ভয়ংকর বিপদের সম্ভাবনাকে জানান দিতে শুরু করেছিল। তার মোকাবিলায় হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতাই যে একমাত্র মহৌষধ, ভারতীয় উপমহাদেশে এই চেতনা বিকাশের প্রথম কৃতিত্ব কমিউনিস্টদের। ‘নবযুগ’ পত্রিকার পরেও নজরুলের ‘লাঙল’ আর ‘ধূমকেতু’তে যেভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার লড়াইকে সর্বসাধারণের মধ্যে তুলে আনা হয়েছিল, তা ভারতের রাজনীতিতে একটি নতুন প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিল। এই উদ্যোগের আগে সেভাবে সংগঠিত প্রক্রিয়ায় মেহনতি জনতার দাবিকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে ভারতবাসী মুক্ত হতে পারে—কমিউনিস্টরা ছাড়া আর কেউ বলেননি।


ভারতের জাতীয় আন্দোলন কমিউনিস্টরা শক্তিশালী হওয়ার আগে কখনোই শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের প্রতি আত্মনিবেদিত ছিল না। ব্রিটিশরা চলে গেলে কী হবে, ভারতের শাসনপ্রক্রিয়ারও কোনো সঠিক দিশা ছিল না জাতীয় আন্দোলনের সেই ধারাতে। ব্রিটিশের ভারতীয় সংস্করণের হাতেই যে ব্রিটিশমুক্ত ভারতের শাসনক্ষমতা আবর্তিত হবে, সেদিকেই ছিল জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলনের লক্ষ্য।
এই গতিপথে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। তাঁদের রাজনৈতিক সাফল্য এমন একটা জায়গাতে পৌঁছে গিয়েছিল, বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ, আইএনএর বিচারের প্রতিবাদ, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশের মনে এই আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছিল, যদি তারা তড়িঘড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, কংগ্রেস আর আন্দোলনকে ধরে রাখতে পারবে না। আন্দোলনের রাশ কমিউনিস্টদের হাতে চলে যাবে।


সেই রাজনৈতিক সাফল্য কেন স্বাধীন ভারতে ধরে রাখতে পারল না, এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বি টি রণদিভে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে যে সাংস্কৃতিক নীতি দল গ্রহণ করে—তা শ্রেণিসংগ্রামের যে ধারা ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বিকাশ লাভের কাল থেকে অনুসরণ করেছিল—তা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। বাংলাতে কমিউনিস্ট পার্টিকে মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে যে সংস্কৃতিকর্মীরা জানকবুল লড়াই শুরু করেছিলেন, বি টি রণদিভের রাজনৈতিক লাইনের জন্য তাতে ছেদ পড়ে। উদাহরণ হিসেবে ঋত্বিক ঘটক থেকে কলিম শরাফীর নাম করা যেতে পারে। কলিম শরাফীর মতো মানুষ মুখ্যত রণদিভের আমলে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দমবন্ধ অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরেই ভারত ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান।

পণ্ডিত নেহরুর আমল থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন কমিউনিস্টরা। জ্যোতি বসু, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গীতা মুখার্জী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসু, সইফুদ্দিন চৌধুরীদের মতো সংসদীয় রাজনীতিতে দক্ষ ব্যক্তিরা আর সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অজয় ঘোষ, পি সি যোশী থেকে হরকিষান সিং সুরজিত, প্রমোদ দাশগুপ্তরা ভারতের জাতীয় রাজনীতির আবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে কমিউনিস্টদের প্রাসঙ্গিকতার সাক্ষ্য রেখেছেন। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতাতেই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন জ্যোতি বসু। সংসদীয় রাজনীতির ধারাতে বিশ্বের ইতিহাসে একমাত্র কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব, যাঁর কাছে জয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব আসে আর দলীয় সম্মতি না থাকায় তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।


কমিউনিস্ট হিসেবে ভারতের রাজনীতিতে যে বাস্তব বোধের সার্বিক গুণের অধিকারী ছিলেন জ্যোতিবাবু, আজকের ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে সেই সার্বিক গুণের উত্তরাধিকারী হলেন মহ. সেলিম। জ্যোতিবাবু যেমন নিছক কেতাবি কমিউনিস্ট ছিলেন না, সেলিমও তেমনি কেবল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোকে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়ে রাজনীতি করেন না। আজকের ভারতে নয়া উদার অর্থনীতিকে রুখতে গেলে সবার আগে দরকার ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে আটকানো—এই বাস্তববোধের সার্বিক অধিকারী হলেন সেলিম। জ্যোতিবাবুর ভেতরে যেমন কোনো দলীয় সংকীর্ণতা ছিল না, সেই দুর্লভ গুণের অন্যতম সেরা অর্জনকারী হলেন সেলিম। ভারতের রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের গুরুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সেলিম হলেন সর্বোচ্চ যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব।

*গৌতম রায়: পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।