কুড়িগ্রামের মানুষ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে

পাঁচ দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে কুড়িগ্রামবাসীর জীবন–জীবিকা
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানাজরিপ প্রতিবেদন সূত্রে এ জেলায় গড় দারিদ্র্য ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের পর গত চার বছরে কুড়িগ্রামে দারিদ্র্য কমতে পারে কিংবা বৈষম্য দূর হতে পারে, এমন কোনো কর্মসূচি সরকার গ্রহণ করেনি। ২০১৭ সালে কুড়িগ্রামে যে বন্যা হয়েছিল, তা ২০০ বছরের বন্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সেই বন্যার ক্ষতি এখনো অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও কুড়িগ্রামে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ২০২০ সালে এসে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় এ জেলায় ক্ষতি হয়েছে এক মৌসুমেই ছয়বার। করোনার ভয়াল থাবায় এ জেলার মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেশি ভয়াবহ।

কুড়িগ্রামে উপর্যুপরি সাত আঘাত

প্রথম বন্যা হয় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। সেই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই দ্বিতীয় বন্যা শুরু হয়। দ্বিতীয় বন্যার পানি নেমে যাওয়ার আগেই শুরু হয় তৃতীয় বন্যা। এরপর চতুর্থ ও পঞ্চমবারের মতো ভয়াবহ বন্যায় জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। করোনা, জলাবদ্ধতা ও পাঁচ বন্যা মিলে মোট সাতবার আঘাত এসেছে কুড়িগ্রামবাসীর ওপর। গত আট মাসে করোনা আর ধারাবাহিক বন্যার প্রকোপে ছিন্নভিন্ন এখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অর্থনীতি।

কুড়িগ্রামে গরিব মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ ৬৫ হাজার। সরকার উদ্যোগ নিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এসব গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কুড়িগ্রামবাসী প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আশা করে। কুড়িগ্রামবাসী মনে করে, তিনিই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নয়নের মূলধারায় কুড়িগ্রামকে ফেরাতে পারেন

করোনায় কর্মহীন লাখ লাখ মানুষ

কুড়িগ্রামে করোনার কারণে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে নিজ নিজ গ্রামে ফিরেছেন। এখানে তাঁদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। এ জেলায় অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি এমন একটি জেলা, যেখানে কৃষি ছাড়া আর কোনো অবলম্বনও নেই।

বোরো ও আমন ধানের ক্ষতি

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ঠিক ধান পাকার যখন সময় হয়ে আসছে, ঠিক তখনই বড় বৃষ্টি দেখা দিয়েছিল। জমির ধান পাকার আগেই সেই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে। পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়নি বলে সেটিকে বন্যা বলা হয় না। কিন্তু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ওই বৃষ্টির জলাবদ্ধতায় হয়েছে।

অন্যদিকে বন্যার পানি যতবার নেমেছে, বলতে গেলে ততবারই ফসল লাগানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সেই ফসল বন্যার গর্ভে চলে গেছে। সর্বশেষ যে ধান লাগানো হয়েছিল, তা দীর্ঘ বন্যায় শেষ হয়েছে। বাস্তবতা হলো, মে মাসে বোরো ধান অনেকেই ঘরে তুলতে পারেননি। আর আমন ধান কয়েকবার লাগানো হলেও ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে বছরের দুটি ফসলই শেষ। এতে নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনের চারদিকে ঘন অন্ধকার।

মাছচাষিদের হাহাকার

কুড়িগ্রামে এখন প্রচুর পরিমাণে পুকুরে মাছ চাষ করা হয়। কয়েকবারের বন্যায় কুড়িগ্রামে অসংখ্য পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। মাছচাষিদের জীবনেও নেমে এসেছে গোপন কান্না। প্রকৃত মাছচাষিরাও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোনো প্রণোদনা পান না। জেলায় অনেক বিল আছে। এ জেলার মৎস্যজীবীরা সেই বিলে মাছ ধরতে পারেন না। জেনেশুনেই সরকার এই বিলগুলো অমৎস্যজীবী বিত্তশালীদের কাছে লিজ দিয়ে থাকে। এ কারণেও হাজার হাজার মৎস্যজীবী কাজ হারিয়ে বেকার জীবন যাপন করছেন।

নদীভাঙনে দিশেহারা মানুষ

কুড়িগ্রামে প্রতিবছর নদীভাঙনে হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। এমনও পরিবার আছে, যাদের বাড়ি এক জীবনে ১৫ থেকে ২০ বার ভেঙেছে। যাঁরা নদীভাঙনের শিকার হন, তাঁদের জন্যও রাষ্ট্র কিছুই করে না। এসব মানুষ নেহাতই নিয়তির সন্তান। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধরসহ বেশ কয়েকটি নদ–নদীতে ব্যাপক ভাঙন চলে গোটা বর্ষার মৌসুমে। তবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। কুড়িগ্রামের অনেক মৌজা ভাঙনে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।

মানবিক সাহায্য থেকে দূরে কুড়িগ্রাম

রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের ফাঁদে পড়ে কুড়িগ্রামকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। কুড়িগ্রাম যখনই মহাবিপদে পড়েছে, তখনই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছেন কুড়িগ্রামের জন্য। করোনাকালে সারা দেশ যখন বিপর্যস্ত হয়েছে, তখন সবাই নিজ নিজ অঞ্চলে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। এ কারণে কুড়িগ্রামে এবার বিশেষ মানবিক সাহায্য পৌঁছায়নি। তবে কুড়িগ্রামের মানুষ করুণা প্রার্থনার চেয়ে কর্মসংস্থান চান। সরকারিভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা দেখা যায় না। বেসরকারিভাবেও সে কাজ হচ্ছে না।

রাজনীতিকদের দায়

কুড়িগ্রাম যে বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা, সে কথা স্থানীয় অনেক রাজনীতিক বিশ্বাসই করতে চান না। তাঁরা যখন সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে থাকেন, তখন তাঁরা কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর ওপর দুটি সেতু, সরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালুর পুরোনো রেকর্ড বাজিয়ে চলেন। প্রধানমন্ত্রী-ঘোষিত প্রতিশ্রুতি যে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, সেসব তাঁরা বলেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চিলমারী নৌবন্দরের কাজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রগতি নেই, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হবে কি না, কেউ বলতে পারেন না, অর্থনৈতিক অঞ্চলের আলাপও থেমে গেছে। স্থানীয় রাজনীতিকেরা হয়তো জানেন না বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি হাজার ভাগের এক ভাগও কুড়িগ্রাম জেলা পায় না। এ কারণে কুড়িগ্রামের অধিকাংশ রাজনীতিক বৈষম্য নিয়ে কোনো কথা বলেন না।

কর্মসংস্থানই পথ

কুড়িগ্রামে গরিব মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ ৬৫ হাজার। সরকার উদ্যোগ নিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এসব গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে কুড়িগ্রামবাসী প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আশা করে। কুড়িগ্রামবাসী মনে করে, তিনিই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নয়নের মূলধারায় কুড়িগ্রামকে ফেরাতে পারেন।


তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।