কূটনীতি নাকি ন্যায়বিচার নিষেধাজ্ঞা সামলাবে

র‍্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাড়ার আর সম্ভাবনা নেই বলে ঘোষণা থেকে ধারণা মেলে যে সরকার কূটনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করায় কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। সাংবাদিকদের কাছে কথাগুলো বলেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ইঙ্গিত মিলছে, সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে, তার সবই মূলত হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে কেবলই আন্তর্জাতিক পরিসরে অপপ্রচার হিসেবে বিবেচনা করছে, অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই বা মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে না। এই কৌশল কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত?

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিষয়টি নিয়ে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেন, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আমরা যে সাড়া পেয়েছি, তাতে আর নিষেধাজ্ঞার কোনো আশঙ্কা দেখি না। অন্য কোথাও এর প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞায় অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেনি। অন্য কোনো দেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটেনি, সেটি সত্যিই সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক একটি বিষয়। কেননা, ওই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সময় মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া ও বেলারুশের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে কানাডা ও যুক্তরাজ্য একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা যে গোপনীয়, সে কথা তিনি উল্লেখ না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ওয়াশিংটনের গতিবিধি অনুমান করা সহজ নয় বরং বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই বেশি। আমাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর থেকে জিএসপি-সুবিধা প্রত্যাহারের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ৯ বছর আগে কিছুদিন পরপর আমাদের আশার আলো দেখানো হতো যে শিগগিরই আমরা জিএসপি ফিরে পাচ্ছি, যা এখনো পাইনি এবং সেই আশাও ছেড়ে দিতে হয়েছে। জিএসপি ফিরে পেতে লবিস্টদের পেছনে কত অযুত ডলার খরচ হয়েছে, বিজিএমইএকে তা জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে। এমনকি তাদের দাবিমতো পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থার সংস্কারে দুটি বিদেশি তদারককারী প্রতিষ্ঠানের (একর্ড ও অ্যালায়েন্স) খবরদারি মেনে কারখানাগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তনেও তাদের তুষ্ট করা যায়নি। শ্রমিক অধিকারের প্রশ্ন এখনো তাদের মতে অনিষ্পন্ন হয়ে আছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকারের বিষয় দেখাশোনার জন্য একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি বিশেষ সেল করা হয়েছে বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগগুলোর স্বাধীন, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার না হলে ওই সেল কী ব্যাখ্যা হাজির করবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা কি থেমে যাবে? গুমের শিকার পরিবারগুলোর কাছে এত দিন পর নতুন করে তথ্য চাইতে গেলে হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠাই কি স্বাভাবিক নয়?

আমার আলোচ্য অবশ্য পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের অন্য একটি অংশ, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘বিরোধী দলের ওপর র‍্যাবের দমন–পীড়নের অভিযোগ সত্য নয়, কারণ, নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক।’ তিনি বলেন, টেকনাফের যে কাউন্সিলরকে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগের ছিলেন। মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা বা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা র‍্যাব অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিহত হয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্যে কি র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেনে নেওয়া হলো না? বিরোধী দল দমন না হলেও কি বিচারবহির্ভূত হত্যা গ্রহণযোগ্য? র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের নজির হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুলের হত্যার ঘটনাটির উল্লেখ ছিল। সেই অভিযোগের তদন্তে কী করা হচ্ছে, তার কোনো উল্লেখ না করে মাদকবিরোধী অভিযানে তাঁর প্রাণ হারানোকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা উদ্বেগজনক।

আরও পড়ুন

কাউন্সিলর একরামুল ছাড়াও তিনি র‍্যাবের হাতে নিহত ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা বা সংগঠনের উল্লেখ করে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় তাঁদের প্রাণ হারানোর তথ্য দিয়ে কী বোঝাতে চাইলেন? তাঁর দল একটি বড় দল সন্দেহ নেই কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের ওপর কি তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? মাদকের কারবারে তাঁরা এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন যে তাঁদের বিনা বিচারে মেরে ফেলাই তাহলে অঘোষিত নীতি? প্রতিমন্ত্রী কি মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন পড়ে দেখেছিলেন? গুমবিষয়ক প্রতিবেদনে (ডেকেড অব ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস) তাঁরা যে ৮৬ জনের নাম-পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ বা প্রত্যক্ষদর্শীর কথা তুলে ধরেছিলেন, সেই তালিকাতেও তাঁরা অন্তত ১০ জনকে আওয়ামী লীগের সদস্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন। স্পষ্টতই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে বিরোধী দল দমনের বিষয়টি থাকলেও তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি শুধু তাঁদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কথাও বলেছেন।

আরও পড়ুন

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খণ্ডনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা নতুন কিছু নয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষ দুই দিনে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির যে সভায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছিল, সেই সভায় আইনমন্ত্রীর সঙ্গে শাহরিয়ার আলমও ছিলেন। ঘটনাচক্রে আমি হঠাৎ আবিষ্কার করি যে প্রতিমন্ত্রী যে হোটেলে আছেন, আমিও সেখানেই আছি এবং তাঁর সঙ্গে সেবারই আমার প্রথম পরিচয়। ওই সভায় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মিস এফ গায়ের কক্সবাজারে একরামুলকে হেফাজতে নেওয়ার পর তাঁকে হত্যার আওয়াজ মুঠোফোনে তাঁর পরিবারের শোনার ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ২০১৭ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার গুমবিষয়ক কমিটি র‍্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে যে কয়টি অভিযোগের তথ্য চেয়েছিল, ২০১৯ সালের ওই সভায় বলা হয় যে সেগুলোর জবাব মেলেনি। কমিটির নথি বলছে, তারা আজও সে জবাব পায়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগের তদন্তের বিষয়ে কমিটির সদস্যদের উপর্যুপরি প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার বিচারের কথা তুলে ধরেছিলেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন সাবেক একজন মন্ত্রীর জামাই উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রমাণ করে সরকার এসব বিষয়ে কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা কমিটির সদস্যদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাঁরা আবারও জানতে চেয়েছিলেন যে স্বাধীন বেসামরিক একটি তদন্ত অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না। আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের যে ১২৬তম বৈঠক হবে, তাতে ২৪টি দেশের গুমের বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হবে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। কমিটির প্রস্তুত করা নথিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ৭৬টি গুমের অভিযোগ তাদের বিবেচনায় রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকারের বিষয় দেখাশোনার জন্য একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি বিশেষ সেল করা হয়েছে বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিযোগগুলোর স্বাধীন, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার না হলে ওই সেল কী ব্যাখ্যা হাজির করবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা কি থেমে যাবে? গুমের শিকার পরিবারগুলোর কাছে এত দিন পর নতুন করে তথ্য চাইতে গেলে হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠাই কি স্বাভাবিক নয়?

আসল কাজটা হচ্ছে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের। স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের আইনগত পদক্ষেপ নির্ভর করে তাদের ওপর। কিন্তু তারা হয় নির্বিকার, নয়তো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। কূটনীতির ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছুটা দ্ব্যর্থবোধক হয়ে থাকে। আর সেই অস্পষ্টতার কারণে ভুল কৌশলের পেছনে সম্পদ ও সময়ের অপচয় কখনোই কাম্য নয়।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক