কেমন আছে তিস্তা আর তিস্তাপারের মানুষ?

তিস্তা নদীর সুরক্ষা, বন্যা-ভাঙনরোধ, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি অনেক পালিত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে তোলা।
ছবি: মঈনুল ইসলাম

তিস্তা নদীর ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ নির্ভরশীল। সেই বিবেচনায় এ নদীর প্রতি পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় পরিচর্যা থাকার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা নেই বললেই চলে। ৪০ বছর আগেও নদীটি বাংলাদেশ অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রস্থে ছিল ২ কিলোমিটার, শুষ্ক মৌসুমে ১ কিলোমিটার। অপরিকল্পিতভাবে নদী রক্ষা বাঁধ এবং ব্যারাজ নির্মাণের ফলে নদীটি এখন কোথাও কোথাও প্রস্থে প্রায় ১০ কিলোমিটার হয়েছে। নদীটি তার গভীরতা হারিয়েছে। প্রতিবছর দুই পাড়ে যে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, তা দিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ বালু এসেও নদীর তলদেশ ক্রমেই স্ফীত হয়ে উঠছে। এখন কোথাও কোথাও নদীর তলদেশ সমতল ভূমির চেয়ে অনেক উঁচু।

তিস্তা যখন প্রস্থে ১ থেকে ২ কিলোমিটার ছিল, তখন পানির বেগ ছিল প্রচুর। সেই বেগে নদীর তলদেশ গভীর হতো। কৃত্রিমভাবে তিস্তার তলদেশ খনন করে অতীতে এর গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়নি, গভীর হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। নদী রক্ষা বাঁধের নামে উৎসমুখ বন্ধ করে ঘাঘট-মানাস-বাইশাডারার মতো শাখা নদীগুলোকে তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী কোথাও কোথাও হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো বছর জুতা পরেই পার হওয়া যায়। তিস্তা নদী ছিল বারোমাসি নদী। শুষ্ক মৌসুমেও অনেক পানি থাকত। এখন শুষ্ক মৌসুমে যেন নদী কঙ্কাল পড়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এ নদী পানিহীন হয়ে পড়লে অর্ধলক্ষাধিক জেলে-মাঝি কার্যত বেকার হয়ে পড়েন। জেলে-মাঝিরা অন্য কোনো কাজ শেখেননি। ফলে তাঁদের পরিবারে নেমে আসে সীমাহীন কষ্ট।

তিস্তায় আগে বহু প্রজাতির মাছ ছিল। এখন মাছের প্রজাতি কমে এসেছে। অনেক রকম ছোট-বড় কীটপতঙ্গ ছিল, এখন আর সেসব নেই। অতীতে নদীতে প্রচুর পরিমাণে শৈবাল দেখা যেত। এখন আর তা নেই। কচ্ছপ, শুশুক ছিল। এখন বর্ষা মৌসুমে কদাচিৎ শুশুক দেখা গেলেও কচ্ছপ আর নেই। এ নদীতে আগে শীত মৌসুমে প্রচুর পাখি আসত। এখন আর আগের মতো পাখিও আসে না। নদীতে প্রচুর নৌকা চলত, এখন আর সেই নৌকাও চলে না। এসব অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বলা যায় তিস্তা ভালো নেই। ভালো নেই তিস্তার দুপাড়ের সাধারণ মানুষ।

তিস্তা নদীতে পানি না থাকলে এ নদীর পাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এ অবস্থায় যখন গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে কৃষিকাজ করা হয়, তখন পানির স্তর আরও নিচে নেমে যায়। এ রকম দীর্ঘদিন চলতে থাকলে নদী-কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর সাংঘাতিক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষতিকর প্রভাব কিছু কিছু পড়তে শুরু করেছে।

বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা সেচপ্রকল্পের আওতায় ডালিয়া ব্যারাজের সব গেট বন্ধ রেখে পানি জমিয়ে সেই পানিতে চাষাবাদ করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এতে কিছুটা কৃষির উপকার হলেও ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। ভারত পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে তিস্তা এমনিতেই মরণাপন্ন। তার ওপর যদি অবশিষ্ট পানি ব্যারাজে বন্ধ রেখে কৃষিকাজ করা হয়, তাহলে নদী বাঁচবে কোন পানিতে?

তিস্তা মিলিত হয় ব্রহ্মপুত্রে। ব্রহ্মপুত্র যমুনা নাম নিয়ে পদ্মায় মিলিত হয়। এরপর সেই পানি চলে যায় সমুদ্রে। উজান থেকে সমুদ্রে পানির চাপ যত বেশি থাকবে সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি তত কম ওপরে উঠে আসবে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে তিস্তার পানিপ্রবাহ নেই। যেটুকু আছে সেটুকুও বাংলাদেশে সেচপ্রকল্পের কাজে ব্যবহার করার কারণে উপকূলবর্তী জনজীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নদীর ক্ষতি শুধু উত্তরাঞ্চলে নয়, সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।

‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ সম্প্রতি তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও নদীর দুপারের কৃষি ও জনজীবন সুরক্ষার দাবিতে ২৩০ কিলোমিটার মানববন্ধন করেছে। শোনা যাচ্ছে সরকার এ নদীকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা করছে। নদীর স্বার্থ বজায় রেখে মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন দাবি করেছে এ সংগঠন। তিস্তাপারের মানুষের আন্দোলন চলমান রয়েছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিস্তাবিষয়ক চুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে যৌথ নদী রক্ষা কমিশনের সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর সেই চেষ্টা কার্যত থেমে গিয়েছিল। তিস্তা নদীর আলোচনা শুরু করার প্রায় ৫০ বছর হলো। এই ৫০ বছরে ভারতে অনেকবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। বাংলাদেশেও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে অনেকবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে শুরু হওয়া তিস্তা চুক্তি আজও অমীমাংসিত। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার প্রতিবাদে এবং তিস্তা চুক্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দাবি আরও জোরালো হওয়া প্রয়োজন।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিস্তার পানি বণ্টনবিষয়ক একটি আলোচনার অগ্রগতি হয়েছিল। সে বছর বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসার কথা ছিল। তখন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন না আর পানি বণ্টন চুক্তিও হয়নি। তারপর ৯ বছর কেটে গেছে। চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশই যেন নিষ্ক্রিয় হচ্ছে। এই নিষ্ক্রিয়তায় ভারত লাভবান হলেও বাংলাদেশকে এর চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। তিস্তা সেচপ্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি রেখেও প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হতো। এখন পানির অভাবে নদীকে বাঁচানো যাচ্ছে না।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে চলতি মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর এই আগমন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। অর্ধশত বছর থেকে ঝুলে যাওয়া আলোচনা যদি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষেও বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সেটি আরও অর্থপূর্ণ হতে পারে। সময় এখনো চলে যায়নি। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে জনগুরুত্বপূর্ণ তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হলে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসেও এই আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]