গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন: ফিরে দেখা ৪০ বছর


সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। দেখতে দেখতে বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন চার দশক পার করল। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। ১৯৭৬ সালের ১৫ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দলগুলো ও চট্টগ্রামের একটি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রথম একটি ব্যাপকভিত্তিক নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। অধ্যাপক মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন তখন একাডেমির মহাপরিচালক। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৫ থেকে ২৭ এপ্রিল মহিলা সমিতি মিলনায়তনে আমরা নাট্যদলগুলো মিলে গ্রুপ থিয়েটার উৎসব ’৭৯ আয়োজন করি। ঢাকার ১৭টি দল উৎসবে নাটক অভিনয় করে। ১১ সদস্যের উৎসব পরিচালনা পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সংঘবদ্ধভাবে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত প্রয়াস ছিল এই উৎসব। নিজস্ব শক্তিতে আয়োজিত এই উৎসব আমাদের উৎসাহিত করেছিল একটি সংগঠনের মধ্যে একত্র হতে। আবার বিরুদ্ধ মতও ছিল কারও কারও, নাট্যদলগুলোর ঐক্য বজায় থাকবে না সাংগঠনিক কাঠামোয় এলে।
থিয়েটার পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমি ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে নাট্যদলগুলোর একটি প্রতিনিধি সভা আহ্বান করেছিলাম। মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে সেদিনের সভায় ঢাকার ২১টি, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৭টিসহ মোট ৩৮টি নাট্যদলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিনের সভায় নাট্যদলগুলোর একটি ফেডারেশন গঠনের ব্যাপারে সবাই একমত হন। তাই ২৯ নভেম্বরকেই পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত করা হলো গ্রুপ থিয়েটার দিবস হিসেবে।

ফেডারেশন জন্মলগ্ন থেকে শতাব্দীপ্রাচীন কালাকানুন অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের দাবিতে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রাম করেছে সভা-সমিতি, অনশন-মিছিল, সেন্সরবিহীন নাটক পরিবেশনা—কতভাবে যে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে নাট্যকর্মীরা, আজ তার সম্পূর্ণ ইতিহাস মনেও করতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের জয় হয়েছে।

তবে আরও একটি ব্যাপক প্রতিনিধিত্বশীল সভার আয়োজন করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা হয়। সে অনুযায়ী পরবর্তী সভা হয় ১৯৮১ সালের ৪ জানুয়ারি। নাটোরের সাকাম-সংস্থার অধ্যক্ষ শফিউদ্দিন সরদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠিত হয়। সদস্য সংগ্রহ, গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং প্রথম সম্মেলন করার জন্য আমাকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ১১ সদস্যের একটি প্রস্তুতি কমিটি।
১৯৮৩ সালের ২৩ আগস্ট মহিলা সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় নবগঠিত ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন। ইতিমধ্যে ১০১টি আবেদনকারী দল থেকে বাছাই করে ৬৭টি নাট্যদলকে ফেডারেশনের সদস্যপদ দেওয়া হয়। সম্মেলন উদ্বোধন করেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় অভিনেতা মোহাম্মদ জাকারিয়া; যিনি উপমহাদেশের প্রথম গ্রুপ থিয়েটার বহুরূপীর সূচনালগ্নেও জড়িত ছিলেন। এই সম্মেলনে ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র গৃহীত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় পরিষদ নির্বাচিত হয়। নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও আমার ওপর অর্পিত হয় যথাক্রমে সেক্রেটারি জেনারেল ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব।
৪০ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে অর্জন-ব্যর্থতা—দুই-ই চোখে পড়ে। তবে নিঃসন্দেহে অর্জনের পাল্লা অনেক ভারী। ফেডারেশন আজ নাট্যকর্মীদের সমবেত শক্তি। এত রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যেও ফেডারেশনের ঐক্যে কোনো ফাটল ধরেনি এবং সহজে ধরবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

ফেডারেশন জন্মলগ্ন থেকে শতাব্দীপ্রাচীন কালাকানুন অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের দাবিতে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রাম করেছে সভা-সমিতি, অনশন-মিছিল, সেন্সরবিহীন নাটক পরিবেশনা—কতভাবে যে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে নাট্যকর্মীরা, আজ তার সম্পূর্ণ ইতিহাস মনেও করতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের জয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে সেন্সর প্রথা সহজ করেছিলেন এবং নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর প্রত্যাহার করেছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করে এবং আমাদের ওপর থেকে সরে যায় সেই জগদ্দল পাথর।
ফেডারেশনের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, পুরোনোদের পাশাপাশি অবশ্যই নতুনদের তৈরি হতে হবে এবং দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং আমি ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অন্যতম। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা শিল্পদর্শন ভিন্ন হলেও কখনো তা ফেডারেশনের কাজে কোনো প্রতিবন্ধক হয়নি। একজনের নেতৃত্ব বাকিরা মেনে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে এই সমঝোতা নিয়ে আমি সব সময় গর্ববোধ করি। ফেডারেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ৪০ বছর পর ফেডারেশনের আজকের শক্তি ও সাফল্য আমাকে আনন্দিত করে। পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতার জন্যও মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের নাটকের সামগ্রিক মান উন্নয়নে আমরা তেমন কোনো অবদান রাখতে পারিনি। নাটক করা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার, তাই কোনো প্রযোজনাকে খারাপ বলতে পারি না। ফেডারেশনে উত্তম-অধম সবারই একদর। সারা দেশে আমরা কিছু ‘তথাকথিত নেতা’ তৈরি করেছি, যারা সারাক্ষণ নাটকের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শিল্পের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। নির্বাচনেই তাদের প্রবল উৎসাহ।
ফেডারেশনের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি কি বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ব্যাপকতার পরিচায়ক? উত্তর ইতিবাচক হলে আমরা আনন্দিত হতাম। কিন্তু বাস্তবতা অন্য চিত্র তুলে ধরে। এই ৩০০-এর বেশি সদস্য দলের মধ্যে কতগুলো দল সক্রিয়? কতগুলো দল বছরে অন্তত ৫টি করে প্রদর্শনী করেছে? ঢাকার বাইরে কটি শহরে নিয়মিত নাটক হয়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পরিস্থিতিটা আশাজাগানিয়া নয়। কিন্তু বাংলাদেশের নাটক মানেই তো ঢাকার নাটক নয়। সারা দেশ যদি একসঙ্গে নাটক নিয়ে না এগোয়, তবে বাংলাদেশের নাটক অনেক এগিয়ে গেছে—এমন দাবি আমরা করতে পারব না।

আমরা শহরে বা গ্রামে—যেখানেই নাট্যচর্চা করি না কেন, আমাদেরই স্থানীয় পরিস্থিতির আলোকে ভেবে বের করতে হবে, কোন পথে গেলে আমাদের দর্শক তৈরি হবে।

ঢাকার বাইরে নিয়মিত নাট্যচর্চার নানা প্রতিবন্ধকতা আছে জানি। কিন্তু শুরুতে ঢাকায় কি কম সমস্যা ছিল? নাটকের ধর্মই হচ্ছে সব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা। নিয়মিত নাটকের জন্য দর্শক সৃষ্টি করা তো নাট্যদলগুলোরই দায়িত্ব। আমরা শহরে বা গ্রামে—যেখানেই নাট্যচর্চা করি না কেন, আমাদেরই স্থানীয় পরিস্থিতির আলোকে ভেবে বের করতে হবে, কোন পথে গেলে আমাদের দর্শক তৈরি হবে।
এরপরে আসে নাটকের মান প্রসঙ্গ। হামেশাই নতুন নতুন দল হচ্ছে। আমরা কি আমাদের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দল গঠন করছি, না কেবল আবেগতাড়িত হয়ে নতুন পথে পা বাড়াচ্ছি? পুরোনো দলগুলোই কি মানসম্পন্ন নাটক প্রযোজনা করতে পারছে? আজ প্রয়োজন নির্মোহভাবে আত্মসমালোচনা।
ফেডারেশনের যে বিষয়টি আমাকে সব সময় পীড়া দেয় তা হচ্ছে, ফেডারেশন তার প্রতিবাদী চরিত্র হারিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সরকার বা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের সংগ্রামী নাট্যকর্মীদের আহ্বান জানাই, আসুন সংখ্যায় নয়, সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ নাট্যদল ও কর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে প্রতিষ্ঠালগ্নের চেতনায় ফিরিয়ে আনি।
সবাইকে ফেডারেশন দিবসের অভিনন্দন। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

রামেন্দু মজুমদার নাট্যব্যক্তিত্ব