ঢাকার ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির দুই হাজার কোটি টাকা কই যায়?

রাজধানীতে দখল হয়ে যাওয়া একটি ফুটপাত, যেখানে দোকানিরা পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ফুটপাত শব্দটি শুনলেই আমাদের মস্তিষ্কে চলে আসে প্রধান সড়কের পাশের নির্দিষ্ট বাঁধানো পথ, যে পথ দিয়ে খুব সহজেই মানুষ চলাচল করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটপাতগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশের শহরগুলোর অধিকাংশ রাস্তার ফুটপাতে দেখা যায় নানা রকম বিকিকিনির স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকান। রাজধানীর ফুটপাতগুলো যেন চাঁদাবাজির হাটবাজার। অপর দিকে পুলিশ, প্রশাসন এবং কিছু রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মীরা এসব স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফুটপাত বেদখলে সহায়তা করছেন।

ফুটপাতের হকার ও স্থায়ী–অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই শহর বা গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ। এসব হকার ও স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক, নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষ, অল্প শিক্ষিত বেকার—যাঁরা খুব অল্প কিছু মূলধন জোগাড় বা অল্প সুদে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসায় নেমেছেন। অপর দিকে ফুটপাতের ব্যবসায় পুঁজি কম লাগে, একা পরিচালনা করা যায়, ভাড়া বা সিকিউরিটি মানি দিতে হয় না—তাই মানুষ তুলনামূলকভাবে ফুটপাতের ব্যবসাকে লাভজনক মনে করেন। আর এসব ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠছে নানা রকম চাঁদাবাজ চক্র, যারা অর্থের বিনিময় এসব হকার ও ক্ষুদ্র স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের ফুটপাত দখল করে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আমরা দেখি, ফুটপাতে যেসব দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ব্যবসা করেন, তাঁদের নানা রকম বিপদ–আপদের সম্মুখীন হতে হয়। সম্মুখীন হতে হয় নানা রকম চাঁদাবাজ চক্রেরও। চক্রের সদস্যদের নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। নিয়মিত এসব চাঁদাবাজদের অর্থ দিতে না পারলে হকার বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ফুটপাতে বসতে দেওয়া হয় না। রাজধানী ঢাকার প্রধান কিছু সড়ক—নিউমার্কেট, মতিঝিল, গুলিস্তান, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, আরামবাগসহ অনেক জায়গায় লক্ষ করা যায় ফুটপাতে হকার ও স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের রমরমা বাণিজ্য। প্রত্যেক হকার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২০০–৫০০ টাকা পর্যন্ত নানা অনুপাতে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয়।

২০২০ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে মোট হকার আছেন তিন লাখ, যাঁদের গড়ে ১৯২ টাকা করে দৈনিক চাঁদা গুনতে হয়। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে একটি চক্র। সংঘবদ্ধ এ চক্রের পেছনে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ।

ফুটপাতে দোকান করতে হলে চাঁদা দিতে হয়, না দিলে দোকান ভেঙে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় অথবা পুলিশ দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। এমন ভুক্তভোগী এক হকার বলেন, ‘চাঁদা না দিলে পুলিশ দিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানা থেকে ছাড়া পেতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে মারধর করে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

বর্তমানে চাঁদাবাজি এতটাই প্রকট আকার ধারণ করছে যে এ ক্ষেত্রে দুটি গ্রুপ কাজ করছে—একটি গ্রুপ ফুটপাতে অবৈধ দোকানগুলো থেকে ভাড়া আদায় করছে, আরেকটি গ্রুপ চাঁদার টাকা তুলছে। অবৈধ এ টাকার জোরেই ফুটপাত কখনোই পুরোপুরি হকারমুক্ত হয় না। ফুটপাত দখলে নেওয়ায় রাজধানীর অনেক স্থানেই সংকুচিত মানুষের চলার পথ, বাড়ছে যানজট। কোথাও অবৈধ স্থাপনার কারণে, কোথাওবা বিভিন্ন মালামাল রেখে দেওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়েন পথচারীরা। অনেক সময় ফুটপাথের পরিবর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয় পথচারীদের। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসেবে, সারা দেশে দুর্ঘটনায় নিহতের ৪৪ শতাংশ পথচারী এবং শুধু ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এত বিপুল টাকা কোথায় যায়, কার পকেটে যায়, সেটির খোঁজ কেউ রাখেন না। ফুটপাথে অবস্থানরত হকাররা জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্পর্কে জ্ঞান না রাখলেও জাতীয় অর্থনীতিতে কোনো না কোনোভাবে এই অংশের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ফুটপাতে অবস্থিত হকারদের একটি ভালো বিষয় হলো তাঁদের কল্যাণে ঢাকার রাস্তার কোটি কোটি টাকার পচনশীল পণ্য ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে, আমরা রাস্তায় চলাচলের সময় প্রায়ই লক্ষ করে থাকি, বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েরা নানা রকম ফলমূল (যেমন: পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, শসা, আমড়া, জাম্বুরা ইত্যাদি) বিক্রি করে থাকে। এসব ফলফলাদি পচনশীল, তারা যদি এসব পণ্য ফুটপাতে বিক্রি না করত, তাহলে কৃষকের এসব পচনশীল পণ্য খুব সহজেই নষ্ট হয়ে যেত, যার ফলে কৃষকও তাঁর ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেন।

পরিশেষে এটি বলা যায়, সরকার, প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ফুটপাতের হকার বা স্থায়ী-অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের যদি একটি সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলের মধ্যে আনা যায়, তাঁদের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করা যায় এবং চাঁদাবাজ চক্রগুলোকে চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তাহলে জাতীয় অর্থনীতি, পথচারী ও দরিদ্র হকার শ্রেণি—সবার জন্যই সুফল বয়ে আনা সম্ভব হবে।

সামিহা খাতুন
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়