তাঁদের কথাও শোনেনি আওয়ামী লীগ সরকার

পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ছাত্রদল ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের হামলা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে গত মঙ্গলবার তোলাছবি: সাজিদ হোসেন

একটা ভিডিও বোধ হয় অনেকেই দেখেছেন গত দুই দিনে। সেখানে রাগে ফুঁসতে থাকা ছাত্রলীগের মেয়েটির বক্তব্য ছিল সোজাসাপটা। তাঁর হাতে বাঁশ কেন? তিনি বলেছেন, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদককে তিনি এমনভাবে পেটাতে চান, যাতে সে এক মাস হাসপাতালে থাকে। তার অপরাধ? সে নাকি আওয়ামী লীগ নেত্রীকে কটূক্তি করেছে।

ছাত্রদলের অভিযোগ ছিল আরও গুরুতর। তারা মনে করে, তাদের নেত্রীকে পদ্মা সেতু থেকে ‘টুস’ করে ফেলে দেওয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁকে নাকি হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারা অবশ্য এর প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল সমাবেশ আর সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।

নেত্রীর অপমানের জবাব ‘পিটিয়ে দিতে চাওয়ার পক্ষ’ অবশেষে জয়ী হয়েছে। ক্যাম্পাসকে রণক্ষেত্র বানিয়ে তারা পিটিয়েই ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসছাড়া করেছে। তাদের বেধড়ক পেটানো থেকে রেহাই পাননি ছাত্রদলের মেয়েরা পর্যন্ত। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা দিয়েছে, তবে সেখানে প্রহারকারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। পুলিশ এরই মধ্যে গ্রেপ্তারও করেছে, তবে সেটিও অনিবার্যভাবে রড, চাপাতি বা বাঁশ হাতে নিয়ে প্রহারকারীদের নয়, বরং পিটুনি খাওয়া দলের লোকজনকে।

এসব ঘটনা দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে মামুলি বিষয় এখন। শহীদ মিনার অঞ্চলে যখন হামলা চলছিল, আমরা শিক্ষকেরা তাই সামান্য দূরে উৎসবমুখর পরিবেশে সিনেট নির্বাচনে ভোট দিয়ে গেছি। এই ভোটে প্রার্থীদের মধ্যে যৌন নির্যাতন ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কিছু শিক্ষকও ছিলেন, ছিলেন তিন-চারটি করে সেকেন্ড ডিভিশন বা ক্লাস পাওয়া দু-একজন শিক্ষকও। এসবও মামুলি বিষয় এখন। এতই মামুলি যে তাঁদের কেউ কেউ আবার আমাদের ভোটে নির্বাচিতও হন মাঝেমধ্যে।

পড়াশোনা বা গবেষণা গৌণ বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখানে শিরোনাম হয় প্রধানত ছাত্রাবাসে নির্মম নির্যাতন, ভিন্নমতের ওপর অকথ্য আক্রমণ, যৌন নির্যাতন বা দুর্নীতির কারণে। উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র নয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করা হয়েছে ক্ষমতাকে ধরে রাখার দুর্গ হিসেবে। পড়াশোনার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে মহড়া বা মিছিল কিংবা ছাত্রনেতাকে প্রটোকল দেওয়া এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বা এর চেয়েও খারাপ অবস্থা দেশের অন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সিরিয়াল যৌন নির্যাতনে বা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় বা কেউ কেউ নিয়োগ পেয়ে আরও বেশি এসব হীন কর্মে অভিযুক্ত হন—এমন উদাহরণও আছে।

এগুলোও এখন মামুলি বিষয়। পড়াশোনা বা গবেষণা গৌণ বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখানে শিরোনাম হয় প্রধানত ছাত্রাবাসে নির্মম নির্যাতন, ভিন্নমতের ওপর অকথ্য আক্রমণ, যৌন নির্যাতন বা দুর্নীতির কারণে। উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র নয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করা হয়েছে ক্ষমতাকে ধরে রাখার দুর্গ হিসেবে। পড়াশোনার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে মহড়া বা মিছিল কিংবা ছাত্রনেতাকে প্রটোকল দেওয়া এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা বা বিদ্যাচর্চায় অগ্রণীদের নয়, গুরুত্বপূর্ণ পদে এখানে পদায়ন হয় প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ স্তাবকদের। এর প্রতিফলন দেখি আমরা বিশ্বব্যাপী র‌্যাঙ্কিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তলানির অবস্থানে।

প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও হতাশাজনক। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নির্দেশ দিয়ে ঢালাওভাবে জিপিএ–৫ দেওয়া, কোচিং সেন্টার–বাণিজ্য, পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে খামখেয়ালিপূর্ণ নিরীক্ষা, রাজনৈতিক বিবেচনায় পাঠ্যসূচি নির্ধারণ, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি প্রদর্শনের অভাব পরিণত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে।

২.

২০০৯ সালে পরিবর্তনের ম্যানিফেস্টো নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের কাছে অনেকের প্রত্যাশা ছিল পরিস্থিতির উন্নয়নের। সে সময় দেশের বরেণ্য কয়েকজন শিক্ষাবিদের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে এমনই মনে হয়।

কী ছিল তাঁদের প্রত্যাশা? মাত্র কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখায় অধ্যাপক মনজুর আহমেদ আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১০ সালের জুলাই মাসে তাঁদের দেওয়া প্রস্তাবগুলো আওয়ামী লীগ সরকার সুবিবেচনা করবে, এটি হয়তো তাঁরা সত্যিই প্রত্যাশা করেছিলেন। সুবিবেচনা করার মতোই ছিল প্রস্তাবগুলো।

আরও পড়ুন

তাঁদের প্রস্তাবের প্রথম বাক্যেই বলা হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতি দূর হোক, পর্যাপ্ত অর্থায়নসহ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হোক। প্রথম প্রস্তাবেই তাঁরা এ লক্ষ্যে ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন করার এবং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-অছাত্র সবার অপরাধমূলক কার্যকলাপ কঠোরভাবে দমনের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত তখনকার খসড়া শিক্ষানীতিতে সাধারণ মতৈক্য আছে, এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসম্মত ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, তাদের বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা, এসবের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনকে অর্থবহ বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের দক্ষতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ও মেধাবী তরুণদের শিক্ষা পেশায় আনার জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপের (কলেজ ডিগ্রি কার্যক্রমে শিক্ষক প্রস্তুতি কোর্স, কোর্স শেষে অন্তত পাঁচ বছর আকর্ষণীয় বেতনে শিক্ষকতায় নিয়োজিত রাখা, এদের নিয়ে জাতীয় শিক্ষক কোর গঠন) কথা বলেছিলেন। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম রাজনৈতিক হিসাবের ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা এবং শিক্ষা খাতে সরকারি অর্থায়ন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

‘বর্তমান সরকারের কাছে সচেতন নাগরিক সমাজসহ সব মানুষের প্রত্যাশা বিপুল’ এটি বলে তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে শেখ হাসিনার সরকারের কাছে এসব বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন।

আমাদের এই বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন শুধু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, এই দিকনির্দেশনাগুলো অনেকাংশে বাস্তবায়ন হয়নি এবং এর কারণ হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রকে গুরুত্ব না দেওয়া। তিনি শিক্ষার বেসরকারীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের সমস্যার কথা বলেছেন। তবে শিক্ষার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকীকরণের কথা বলেননি।

৩.

আমার মতে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ অবশ্যই একটি বড় সমস্যা। তবে তার চেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিকীকরণ। সেটার কদর্য রূপের কথা নিবন্ধের সূচনাতেই বলেছি। আসলে এর গভীরতা আরও ব্যাপক। যেমন বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচি নির্ধারণ, এমপিওভুক্তিকরণ এবং সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ—এসব অনেকাংশে হয় দলীয় রাজনীতির বিবেচনায়। অবস্থা এমনি দাঁড়িয়েছে যে পাঠদান বাদ দিয়ে শুধু সরকারি দলের কর্মী হয়ে থাকলেও চাকরি হারানোর ভয় থাকে না কারও।

শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিকীকরণের সবচেয়ে জঘন্য রূপ আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। দেশের রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের রেওয়াজ আছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা থাকে ক্ষমতাসীনদের। যাঁরা যত প্রশ্নবিদ্ধভাবে নির্বাচন জিতে নেন, যাঁরা যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা এটি করতে পারেন ততটা উৎকটভাবে।

রাজনৈতিকভাবে কুক্ষিগত রাখার চিন্তা থেকেই হয়তো শিক্ষা খাতের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে আগ্রহ থাকে না ক্ষমতাসীনদের। এর প্রতিফলন আমরা দেখি বাজেটে পুলিশ বা প্রতিরক্ষার তুলনায় শিক্ষাঙ্গনে অতি করুণ বরাদ্দে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও তা অতি নিম্ন। এই বাজেটের একটা বড় অংশ আবার ব্যয় হয় অপরিকল্পিতভাবে বা ক্ষমতার রাজনীতির অনুগামীদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে।

৪.

দেশের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা অবশ্য নিজেদের সন্তানদের শিক্ষার উৎকর্ষ নিয়ে ঠিকই সচেষ্ট থাকেন। নিজেদের সন্তানদের জন্য তাঁরা বেছে নেন দেশ–বিদেশের অকল্পনীয় ব্যয়ের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। তাঁদের সন্তানদের একাংশ বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করে সেখানে নিরাপদ জীবন যাপন করে, অন্য অংশ দেশে ফিরে লুটেরা রাজনীতিতে নতুন মেধা যুক্ত করে।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, এরপরও এ দেশের ক্ষমতাসীনেরা নন্দিত থাকেন বহু মানুষের কাছে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁরা দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের হাতুড়ি, হেলমেট, চাপাতি, পিস্তল ধরিয়ে দেন, আবার তাঁদেরই দিবারাত্রির বন্দনা লাভ করেন। এমনকি কখনো কখনো সমাজের চিন্তার ‘এলিট’রা স্বার্থ বা সীমাবদ্ধতা থেকে যোগ দেন এই বন্দনায়।

দেশের শিক্ষাবিদসহ সচেতন সব মানুষের এসব নিয়েও বলার প্রয়োজন আছে। নাহলে, যত আশাবাদই ব্যক্ত করা হোক, শেষে তা অরণ্যে রোদন হয়ে যাবে। বরেণ্যরা যত সুচিন্তিত প্রস্তাবই দেন না কেন, একসময় তা অলীক মনে হবে।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক