নতুন প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ হতে পারে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব

২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমাতে পরমাণু দুর্ঘটনার কারণে পরমাণুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৩ থেকে বর্তমানে ১০ শতাংশে নেমেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পরমাণুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাধান্য কি হারিয়ে যাবে? তাহলে বিদ্যুতের বিশাল চাহিদা পূরণ হবে কীভাবে? জার্মানি, ইতালি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া কি পারবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভর করে বসবাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী বিনির্মাণের অংশীদার হতে? এবার এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক।

বর্তমানে ১টি জেনারেশন-১, ৪০৫টি জেনারেশন-২, ৩৬টি জেনারেশন-৩/৩‍+ এবং ১টি জেনারেশন-৪-সহ সর্বমোট ৪৪৩টি রিঅ্যাক্টর ৩২টি দেশে চালু রয়েছে এবং ৪৬টি জেনারেশন-৩/৩‍+ রিঅ্যাক্টর ১৭টি দেশে নির্মাণাধীন। জেনারেশন-১ ও জেনারেশন-২ ক্যাটাগরির মোট ৪০৬টি রিঅ্যাক্টর পুরোনো হওয়ার কারণে ২০৩০-৪০ সালের মধ্যে স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল শেষে (৪০ বছর) নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। অন্যদিকে, জার্মানিতে বর্তমানে ছয়টি রিঅ্যাক্টর চালু রয়েছে। ২৬টি রিঅ্যাক্টর নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এবং চালু ৬টি রিঅ্যাক্টর ২০২২ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। জার্মানি নতুন করে আর রিঅ্যাক্টর নির্মাণ না করে শিগগিরই ইতালির অবস্থায় ফিরতে যাচ্ছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও একই পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সত্তর দশকের দিকে সবচেয়ে বেশি রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করে এবং সবশেষ ১০৪টি রিঅ্যাক্টর চালু করে। বর্তমানে সেখানে ৯৪টি রিঅ্যাক্টর চালু রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দুটি রিঅ্যাক্টর নির্মাণাধীন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদেরও ২০৪০-৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এখন যারা বেশ কিছু রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করছে, তারা হচ্ছে রাশিয়া, চীন, ভারত, হাঙ্গেরি আর কিছু নবাগত দেশ—তুর্কি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, বাংলাদেশ ও মিসর। কিন্তু পরমাণুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হলে যতগুলো রিঅ্যাক্টর বন্ধ হবে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রিঅ্যাক্টর নির্মাণ করা প্রয়োজন; কিন্তু তা হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০-৪০ সালের মধ্যে পরমাণুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আশাতীত হারে হ্রাস পাবে। তাহলে উপায়?

তেল, গ্যাস ও কয়লার বাজার অস্থিতিশীল এবং এসব জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ফি বছর বাড়ছে। এগুলোর মজুতও অফুরন্ত নয়। এই জীবাশ্ম জ্বালানি বিশ্ব উষ্ণায়নে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। আমরা জানি, পরমাণুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব (সূত্র: রূপপুরের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য কত? ১৭ অক্টোবর ২০২১, প্রথম আলো)। জনসমর্থনের অভাবে এবং আবারও দুর্ঘটনার আশঙ্কায় পরমাণু প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলো রিঅ্যাক্টর নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে না। অতীতের দুর্ঘটনায় পতিত রিঅ্যাক্টরগুলো ছিল সত্তর দশকের ডিজাইন, দুর্বল নিরাপত্তাবিশিষ্ট এবং আকারেও বড় (জেনারেশন-২)। কিন্তু বর্তমানে জেনারেশন-৩/৩‍+ বড় আকারের রিঅ্যাক্টরের চেয়ে আরও আধুনিক জেনারেশন-৩‍+ এবং জেনারেশন-৪ ক্যাটাগরির ছোট আকারের রিঅ্যাক্টর তৈরি করছে।

সর্বোচ্চ ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রিঅ্যাক্টরগুলোকে আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থা ছোট মডিউলার রিঅ্যাক্টর, অর্থাৎ এসএমআর বলে আখ্যায়িত করেছে। এসএমআর বড় আকারের রিঅ্যাক্টর থেকে আরও উন্নত নিরাপত্তাবিশিষ্ট। এটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তাপ বর্জনের ব্যবস্থা আছে। ফলে এর জ্বালানি দণ্ড গলবে না এবং এর ফলে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে না। এর অন্য সুবিধাগুলো হচ্ছে—কম বিনিয়োগ, কম নিউক্লিয়ার বর্জ্য, কম নির্মাণ সময়, সহজ ফুয়েল সাইকেল, তুলনামূলক সহজ অনুমোদনের পদ্ধতি, দূরবর্তী অফ গ্রিড এলাকায় দীর্ঘ সঞ্চালন লাইন ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা এবং ফ্যাক্টরি সংযোজন ও মডিউলার কন্সট্রাকশনের ফলে সাশ্রয়ী। এখানে চেরনোবিল ও ফুকুশিমার মতো অবস্থা তৈরি হওয়ার মতো কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের রিঅ্যাক্টর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বর্জ্য তাপ দিয়ে হাইড্রোজেন উৎপাদন কিংবা সমুদ্রের লবণাক্ত পানি বিশুদ্ধকরণ এবং ভারী শিল্প চালানো যাবে।

এসএমআরের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ইউএস নটিলাস চালু থেকে। পরমাণুশক্তিধর দেশগুলোয় নিউক্লিয়ার সাবমেরিনে এসএমআর যুক্ত রয়েছে। তখন থেকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে চালু না করার নেপথ্যে ছিল বিদ্যুতের বিশাল চাহিদা, যা ছোট রিঅ্যাক্টর দিয়ে সম্ভব ছিল না। এসএমআরের চেয়ে আরও ছোট রিঅ্যাক্টর, যা মাইক্রোরিঅ্যাক্টর হিসেবে পরিচিত, যাদের ক্ষমতা ২ থেকে সর্বোচ্চ ১০ মেগাওয়াট। এগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানে উন্নয়নাধীন এবং সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহারে এটি আরও বেশি আকর্ষণীয়। বর্তমানে চীনে দুটি, রাশিয়ায় একটি, জাপানে একটি এসএমআর চালু আছে এবং আর্জেন্টিনায় একটি নির্মাণাধীন। ভবিষ্যতে এই রিঅ্যাক্টরগুলো পরীক্ষিত প্রযুক্তি এবং রেফারেন্স প্ল্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, এমনকি জার্মানি, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়াতে বহু এসএমআরের নকশা অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। আবার অনেক দেশে এগুলো উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বের ১৫টি দেশে এসএমআর ও মাইক্রোরিঅ্যাক্টর নির্মাণ করার জন্য বড়-ছোট বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসএমআরের বাজার প্রায় সব দেশে কমবেশি রয়েছে। তবে এসএমআরের ব্যবহার অধিকতর লাভজনক করার জন্য এর সিরিয়াল প্রোডাকশনের প্রয়োজন। এ জন্য আন্তর্জাতিক বৃহৎ বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

আশা করা যাচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বহু দেশ একাধিক এসএমআর চালু করবে। এগুলোর জন্য উপযুক্ত স্থান হচ্ছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নেই, সেসব জায়গা। আমাদের দেশের জন্য এসএমআর অত্যন্ত উপযুক্ত প্রযুক্তি বলে মনে করছি। এখন দরকার জ্বালানি ও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা এবং জাতীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যানে এসএমআরকে যুক্ত করা। এ ছাড়া দরকার পরমাণুশক্তি কমিশন, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদ্যুৎ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্বের মাধ্যমে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এসএমআরের একটি পাইলট প্ল্যান্ট তৈরি করা, যার উদ্দেশ্য হবে কীভাবে এসএমআরকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া যায়। এসএমআরকে সফলভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা গেলে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর দরকার হবে না। এমনকি গ্যাসের অভাবে অলসভাবে পড়ে থাকা ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন স্টিম সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকেও এসএমআর দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে এসব পাওয়ার প্ল্যান্টের সাইটে এসএমআর স্থাপনের জন্য উপযুক্ততা যাচাই করা যেতে পারে।

এ ছাড়া এগুলোর সাইট লাইসেন্সপ্রাপ্যতা বিষয়ে প্রয়োজনীয় রেগুলেশন প্রস্তুতের জন্য বাংলাদেশ পরমাণুশক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থার সহায়তা নিতে পারে। একই সঙ্গে নিউক্লিয়ার ফুয়েল সাইকেল বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কপ ২৬ সম্মেলনে পরিচ্ছন্নশক্তি হিসেবে এসএমআরকে বেছে নেওয়ার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বড় আকারের রিঅ্যাক্টর স্থাপন না করে বরং রূপপুরেই বড় আকারের আরও দুটি রিঅ্যাক্টর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া। এ উদ্যোগ অনেক সহজ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী হবে। এখন দরকার এসএমআর ও মাইক্রোরিঅ্যাক্টর দেশব্যাপী স্থাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা। তাহলেই সম্ভব নিরবচ্ছিন্ন, নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী ও পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের অপার সম্ভাবনা।

মো. শফিকুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক
ই-মেইল: [email protected]