নাগরিক সমাজ কি 'বহিরাগত' হয়ে পড়েছে?

নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি। রাষ্ট্রের নানা অনিয়ম ও অসংগতি নিয়ে কথা বলে সমাজের যে অংশ, তাদেরই নাগরিক সমাজ বলা হয়। এদের অপেক্ষাকৃত অগ্রসর বলে দাবি করা হয়। সেটা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবেও। সমাজের এই অংশ নাগরিকদের পক্ষ হয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলবে—এটাই কাম্য। উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে সুশীল বা নাগরিক সমাজের বিকাশ ঘটলেও প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে এদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনায়ও নাগরিক সমাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্লেটো ও অ্যারিস্টটল বলেছেন, নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের লাগামহীন ক্ষমতাকে টেনে ধরে। কিন্তু প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের প্রায় দুই হাজার বছর পর বাস্তবতা এখন ভিন্ন। নাগরিক সমাজ কি আসলেই নাগরিকদের পক্ষে বলছে? সক্রেটিসকে যখন বিষের পেয়ালা এগিয়ে দেওয়া হলো, তখন ওই সময়কার এথেন্সের নাগরিক সমাজ কি কোনো কথা বলেছিল? নাকি সর্বদা রাষ্ট্রের অনুগামী হয়েই থেকে যাচ্ছে?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই নাগরিক সমাজের অবস্থান ও ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে এক শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে পাশবিক হামলার শিকার হয়েছেন। রাজশাহীতে অপর শিক্ষার্থীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মেরুদণ্ড ও পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এক বীভৎস আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই নিকৃষ্টতম ঘটনা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাঙ্গণেই ঘটছে। অবশ্য এসব নতুন কিছু নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্ষণের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামতে হয়েছিল বছর বিশেক আগে।

অতি সাম্প্রতিক এসব নারকীয় ঘটনার পর যে জিনিসটি বেশি আলোচিত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে, তা হলো নাগরিক সমাজের আশ্চর্য রকম নীরবতা। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই একেবারেই নীরব। একজন নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করার পরও নারীবাদী সংগঠনগুলোর নড়াচড়া দেখা গেল না। আর কিছু না হোক অন্তত লোক দেখানোর জন্যও না। তরিকুলকে হাতুড়িপেটার প্রতিবাদে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কথা বলতে পারত। সাধারণ নাগরিক সমাজ সরব হতে পারত। কিন্তু তেমন কিছু দেখা যায়নি। অবশ্য ওই ঘটনার পর কিছু সচেতন নাগরিক প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। নাগরিক সমাজের বড় অংশই সেখানে যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে জীবন বাঁচাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরু যখন শিক্ষক জাবেদের পা ধরে বসে ছিলেন, তখন পাশেই লেখক আহমেদ ছফার জন্মবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেখানে অনেক বড় বড় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিই বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু নুরু, রাশেদ বা মরিময়দের কথা পরে কেউই বলেননি। নুরুর রক্তাক্ত হওয়া বা মরিয়মের নির্যাতিত হওয়া তাঁদের এক বিন্দুও টলাতে পারেনি।

বিষয়টি শুধু হামলা ও মারধরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; আন্দোলনকারীদের ধরে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেও অস্বীকার করেছে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এখানে ছাত্রলীগ, পুলিশ, চিকিৎসকসহ সবাই যেন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করতে। অথচ এমনকি যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের হাতে আহত সৈনিককেও চিকিৎসাবঞ্চিত করা হয় না।

এত সব ঘটনার পরও কি আশ্চর্য রকমভাবে নীরব ও নির্লিপ্ত বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ। অনেকটা ঝিম ধরা সন্ধ্যায় দিঘির জলের মতোই স্থির হয়ে আছে সবাই।

নাগরিক সমাজের চরিত্র হচ্ছে এরা রাষ্ট্রের সমালোচনা করবে আবার রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও রাখবে। অনেকটা এ রকম যেন এরা রাষ্ট্রকে খানিকটা বকে দেবে। নাগরিক সমাজ এমন একটি ভান ধরবে যে তারা জনগণের হয়ে রাষ্ট্রকে বকে দিচ্ছে। যেহেতু রাষ্ট্রকে বকে দেওয়া হচ্ছে, তাই জনসাধারণের কোনো প্রতিরোধ-আন্দোলনের দরকার নেই। ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোও নাগরিক সমাজের সমালোচনা করে বলেছেন, নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রক্ষমতাকেই সমর্থন ও সহায়তা করে। অথচ আমাদের নাগরিক সমাজ নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনই রাষ্ট্রের বৈষম্যের নীতিকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। সময় হয়তো এটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

পিটুনি খাওয়া অবস্থায় এক শিক্ষকের পা চেপে নুরুর বসে পড়ার দৃশ্যটাও যেন প্রতীকী। নুরু যেন শিক্ষকের পা ধরে গোটা নাগরিক সমাজকেই তাঁদের সহায় হওয়ার ডাক দিয়েছেন। জনতার কাতারে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যেন অনেকটাই আলজেরিয়ান লেখক আলবেয়ার কামুর ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসের চরিত্রের মতোই আগন্তুকের আচরণ করছেন। ‘আউটসাইডার’-এর মূল চরিত্র মরসো মায়ের মৃত্যুর পরদিনই বান্ধবীসমেত সমুদ্রবিহারে যান। সমাজ মনে করে, মরসোর মধ্যে আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার অভাব রয়েছে। সে যেন সমাজের গভীরে আর ঢুকতে পারল না। হতে পারল না সমাজের অংশ। আমাদের নাগরিক সমাজও অনেকটা সমাজ-বিচ্ছিন্ন বহিরাগত হিসেবেই আচরণ করে চলেছে।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি