পাকিস্তানে সব মনোযোগ এখন জাহাঙ্গীর তারিনকে ঘিরে

ইমরান খানের সঙ্গে এক সময় ঘনিষ্ঠতা থাকলেও সাম্প্রতিককালে দূরত্ব তৈরি হয়েছে জাহাঙ্গীর তারিনের। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি এখন আলোচনার কেন্দ্রে
ছবি : এএফপি

পাকিস্তানে ক্ষমতার ক্রিজে নতুন তারকা হিসেবে নাটকীয়ভাবে মনোযোগ কেড়েছেন জাহাঙ্গীর খান তারিন। এখনো তিনি বোলিংয়ের জন্য দৌড়াতে শুরু করেননি, কিন্তু ব্যাটিংয়ে থাকা ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই খানিক আত্মবিশ্বাসের সংকটে পড়ে গেছে। গ্যালারিতেও তুমুল উত্তেজনা চলছে। সবার ধারণা, ১৯৫৩ সালে আজকের বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া তারিনের বলে উইকেট ফেলার মতো গতি আছে।

ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ
ক্ষমতায় থাকার সময় রাজনীতিবিদেরা সচরাচর কেবল সফলতার গল্প শোনান। ইমরান খানের ক্ষমতার বৈধ মেয়াদ আছে আরও ১৮ মাস। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি জানান, দেশে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারেনি তাঁর সরকার। ১০ ফেব্রুয়ারি সরকারি এক অনুষ্ঠানেই এ মন্তব্য করেন তিনি। কেন পিটিআই ‘নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী পরিবর্তন’ আনতে পারল না, তারও উত্তর দিয়েছেন ইমরান। তাঁর ভাষায়, ‘যা আগে বুঝতে পারিনি, ব্যবস্থা এখানে পরিবর্তনের বেদনা নিতে পারে না।’ এও বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থের সঙ্গে সরকারের যোগসূত্র নেই।’ মন্ত্রীদেরও পরোক্ষ সমালোচনা করলেন ব্যর্থতার জন্য। আবার ১০ জন মন্ত্রীকে কাজের জন্য পুরস্কারও দিলেন একই মঞ্চ থেকে।

বিফলতার খোলামেলা স্বীকৃতির সময় ইমরান হয়তো খেয়াল রাখেননি সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা যৌথভাবে মূল্যায়ন হয় জনতার কাছে। পিটিআই সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে পারল না, তার দায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁরও। পাকিস্তানে বিরোধী দলগুলো স্বভাবত সুযোগটি নিতে চাইছে। জোট বেঁধে আরেক দফা চেষ্টায় নেমেছে ইমরানকে সরাতে। আইনসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে চায় তারা।

অনাস্থা প্রস্তাব সাধারণভাবে রাজনৈতিক প্রচারের অস্ত্র হিসেবে আনা হলেও পাকিস্তানে ইমরানবিরোধীদের এবারের হুমকিকে হালকাভাবে নেয়নি কেউ। কারণ, খোদ ইমরানের দল থেকে কয়েকজন পরিষদ সদস্য সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহাঙ্গীর তারিন, একসময় যিনি ইমরানের প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন।

জাহাঙ্গীর তারিনের প্রধান পরিচয় তিনি দেশটির বড় ধনীদের একজন। কয়েক শ মিলিয়ন ডলারের মালিক তিনি। পিটিআইয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলা হতো তাঁকে। দল ক্ষমতায় আসামাত্র এই প্রধান দুই নেতার মধ্যে বনিবনা কমতে থাকে। ফলস্বরূপ ক্ষমতাচর্চার পরিসর থেকে ছিটকে পড়েন তারিন। সরকারের প্রায় তিন বছরের মাথায় কয়েক মাস আগে তিনি দলের ভেতর নিজ অনুসারীদের নিয়ে আলাদা একটা গোষ্ঠী গঠন করেন। অনেকটা প্রকাশ্যেই এসব ঘটে। এর পর থেকে নওয়াজ শরিফের দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে।

পিটিআইয়ের অন্তর্দ্বন্দ্বে বিরোধী শিবিরে চাঙা ভাব
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ অনুযায়ী পাকিস্তানে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করতে জাতীয় পরিষদের ২০ ভাগ সদস্যের সমর্থন লাগে। আর প্রস্তাবটি অনুমোদন হতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। অর্থাৎ ৩৪২ সদস্যের পরিষদে ১৭২ জনের সমর্থনে সেটা পাস হবে। দেশটির জাতীয় পরিষদে এ মুহূর্তে নওয়াজের দল, ভুট্টোদের দল ও ইমরানবিরোধী অন্যদের যৌথ শক্তি ১৫৫-এর মতো। এ রকম হিসাবে অনাস্থা প্রস্তাব আনায় সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা পাস হতে পিটিআইয়ের সহযোগী দলগুলোর সদস্যদের বিরোধী শিবিরে টেনে আনার প্রয়োজন আছে বা পিটিআইয়ের ভেতরকার প্রায় ১৫ সদস্যের সমর্থন লাগবে। বিরোধী দলকে আশাবাদী করছে দ্বিতীয় বিকল্প। পিটিআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা জাহাঙ্গীর তারিন সেই আশা তৈরি করেছেন।

তারিনকে ঘিরে জল্পনাকল্পনা
জাহাঙ্গীর তারিনের প্রধান পরিচয় তিনি দেশটির বড় ধনীদের একজন। কয়েক শ মিলিয়ন ডলারের মালিক তিনি। পিটিআইয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলা হতো তাঁকে। দল ক্ষমতায় আসামাত্র এই প্রধান দুই নেতার মধ্যে বনিবনা কমতে থাকে। ফলস্বরূপ ক্ষমতাচর্চার পরিসর থেকে ছিটকে পড়েন তারিন। সরকারের প্রায় তিন বছরের মাথায় কয়েক মাস আগে তিনি দলের ভেতর নিজ অনুসারীদের নিয়ে আলাদা একটা গোষ্ঠী গঠন করেন। অনেকটা প্রকাশ্যেই এসব ঘটে। এর পর থেকে নওয়াজ শরিফের দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। সম্প্রতি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদে আস্থা ভোট আনা হলে জাতীয় পরিষদে তাঁর অনুসারী শাসক দলের সদস্যরা তাতে সমর্থন দিতে পারেন। অনুমান করা হচ্ছে, তারিনের সঙ্গে আছেন প্রায় ২০ পরিষদ সদস্য। অনাস্থা ভোটে সরকারকে গদিচ্যুত করতে তার চেয়ে কিছু কম ভোট হলেও চলে।

আরও পড়ুন

তবে কেউই নিশ্চিত নন—তারিন সত্যি সত্যি ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নামবেন কি না। তিনি ইমরানের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ যাচ্ছে না।

বিরোধী শিবিরেও টানাপোড়েন আছে
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ইমরান সরকারের ওপর জনগণ বেশ ক্ষুব্ধ এখন। তবে তাঁর জনপ্রিয়তায় তুমুল ধস তৈরি হয়েছে এবং বিরোধী দলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে, পরিস্থিতি ও রকম নয়। বিরোধী দলগুলো পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ আছে বা থাকবে, তারও চূড়ান্ত নিশ্চয়তা নেই; যদিও তারা প্রতিনিয়ত সরকারের সমালোচনা করে।

পিটিআইয়ের অগ্রযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর মদদ ছিল বলে পাকিস্তানে গভীরভাবে বিশ্বাস করা হয়। শক্তিশালী এই মহল এখন যদি জাহাঙ্গীর তারিনকে মদদ দিতে শুরু করে, তাহলে সরকার রক্ষা কিংবা পরবর্তী নির্বাচনে ভালো ফল—উভয়ই ইমরানের জন্য কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে ইমরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দীর্ঘ মেয়াদে মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করল বলা যায়।

আইনসভায় আস্থা ভোটে সফল হতে প্রাথমিকভাবে প্রধান দুই বিরোধী দল নওয়াজের মুসলিম লিগ এবং ভুট্টোদের পিপলস পার্টির মধ্যে অন্তত দুটো বিষয়ে সমঝোতা লাগবে। প্রথমত, তারা এখনই সরকার ফেলে দিতে প্রস্তুত কি না; দ্বিতীয়ত, পরবর্তী সরকার বিষয়ে কী ভাবছে তারা। দ্বিতীয় বিষয়ে মুসলিম লীগ ও পিপিপি একমত হতে পারবে বলে মনে হয় না। বরং উভয়ে যার যার মতো করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক থাকতে আগ্রহী হবে। আবার তাদের আগ্রহের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর চাওয়াও খাপ খেতে হবে।

বিরোধী শিবিরকে এ মুহূর্তে এককাতারে আনার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছেন জমিয়তের মাওলানা ফজলুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ১১-দলীয় পিডিএম (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট)। কিন্তু তিনি ভুট্টোদের বিশেষ আস্থাভাজন নন। এসব কারণে জাহাঙ্গীর তারিন ইমরানবিরোধী অবস্থান নিতে রাজি হলেও আস্থা ভোটের সম্মিলিত প্রস্তাব আইনসভায় কবে উঠবে, তা এখনই নিশ্চিত নয়।

সবাই বুঝতে চাইছে সশস্ত্র বাহিনীর মনোভাব
ইমরান বরাবরই প্রতিপক্ষ হিসেবে কড়া নজরে রেখেছেন শরিফদের। কিন্তু বিপদে পড়ছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিসর থেকে। একদিকে জাহাঙ্গীর তারিন, অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী তাঁকে নিয়ে অসুখী হয়ে পড়ল কি না।

পিটিআইয়ের অগ্রযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর মদদ ছিল বলে পাকিস্তানে গভীরভাবে বিশ্বাস করা হয়। শক্তিশালী এই মহল এখন যদি জাহাঙ্গীর তারিনকে মদদ দিতে শুরু করে, তাহলে সরকার রক্ষা কিংবা পরবর্তী নির্বাচনে ভালো ফল—উভয়ই ইমরানের জন্য কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে ইমরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দীর্ঘ মেয়াদে মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করল বলা যায়।

আরও পড়ুন

পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সব সময়ই রাজনীতির পরিসরে চালকের আসনে থাকতে চেয়েছে। ভুট্টোদের কোণঠাসা করতে পাঞ্জাবে শরিফদের একদা তারাই গড়েপিটে তৈরি করে। আবার নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করে পিটিআইকে তৃতীয় শক্তি বানাতেও ভূমিকা রেখেছে তারা। পাকিস্তানজুড়ে এখন আবার প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—সেনাবাহিনী এবার কী চাইছে? পুরো নকশা যদিও স্পষ্ট নয়, কিন্তু তারা যে নতুন করে রাজনীতির ময়দান সাজাতে চাইছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ইমরানবিরোধীদেরও স্পষ্ট কোনো সবুজ সংকেত দেয়নি তারা।

জনতুষ্টিবাদের করুণ পরিণতি?
ইমরানের ভাগ্যবিপর্যয়ের ক্ষণগণনা কবে থেকে শুরু হয়েছে, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের বহু মত আছে। তিনটি অভিমতের কথা খুব শোনা যাচ্ছে: আমেরিকাকে অপমানজনকভাবে কাবুলত্যাগে বাধ্য করা, সৌদিদের খেপিয়ে তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়া এবং সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সিদ্ধান্তে ভিন্নমত প্রদর্শন।

সৌদি আরবের স্থলবাহিনীর প্রধান জেনারেল ফাহাদ সম্প্রতি ভারতে যে সফর করে গেলেন, সেটা ইমরান সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর হয়েছে। এই সফরকালে ভারতীয় সেনাপ্রধানের সঙ্গে সৌদি জেনারেল ফটোসেশন করলেন এমন এক ছবির সামনে, যেখানে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। অনেকে বলছেন, সৌদি ঊর্ধ্বতন জেনারেলের ভারতে সফর পাকিস্তানের প্রতি পুরোনো বন্ধুর ক্ষোভেরই স্পষ্ট এক প্রকাশ। পাকিস্তান-সৌদি বন্ধুত্বের এ রকম অবক্ষয়ের জন্য এরদোয়ানের সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠতাকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেন বহুজন।

পুরোনো আরেক মিত্র ওয়াশিংটনের সঙ্গেও সম্পর্ক অতিরিক্ত শীতল করেছেন ইমরান কাবুলে গত বছরের পালাবদলকালে আমেরিকাকে অপ্রয়োজনীয় নাকানিচুবানি খাইয়ে। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় আমেরিকা তার বাড়তি নাজেহাল অবস্থার পেছনে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের উৎসাহকে দায়ী করে। তখনকার আইএসআই প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদ ইমরানের বিশেষ পছন্দের। সেই পছন্দের মানুষকেও স্বপদে রাখতে পারেননি ইমরান। এ নিয়ে উল্টো সেনাপ্রধান জেনারেল জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছেন। এভাবেই আপাতত বন্ধুহীন ইমরান। কিন্তু তিনি বলছেন, দেশের সম্পদ পাচারকারীদের সঙ্গে আপস করবেন না। ইমরানের এই অবস্থান শরিফদের ওপর আরও চড়াও হওয়ার ইঙ্গিত আছে। এই ‘দৃঢ়তা’ খুব কাজের হতো, যদি ইমরান তিন বছরের শাসনামলে জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে পারতেন। সেটা হয়নি।

আরও পড়ুন

জীবনমান খারাপ হতে থাকলে নাগরিকেরা বিরোধী দলমুখী হতে থাকে—এটাই রাজনীতির সরল গণিত। ব্যক্তি ইমরান দুর্নীতিগ্রস্ত হননি। কিন্তু জনগণের বিবেচনায় এটাই যথেষ্ট নয়। তারা রুজিরোজগারের অবস্থা দিয়েই সরকারকে দেখে। ইমরান সেখানে খারাপ নজির রেখে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি না করলেও পাকিস্তান দুর্নীতির সূচকে ২০২১ সালে আগের বছরের চেয়ে আরও ১৬ ধাপ নিচে পড়ে গেছে।

ইমরানের এই পরিণতি জনতুষ্টিবাদেরই ঐতিহাসিক নিয়তি। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য দুর্ভাগ্যের দিক—জাহাঙ্গীর তারিনও এ অবস্থার কোনো ভালো সমাধান নন। পিটিআইয়ে ভাঙনমাত্রই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে।

আফগানিস্তানকে ঘিরে চলতে থাকা আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিতীয় অধ্যায় হয়তো এবার ইসলামাবাদে দেখব আমরা।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক