পুতিনের তাণ্ডব থামাতে সংলাপ ছাড়া পথ নেই

ইউক্রেন থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষ পোল্যান্ডের অস্থায়ী শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এবং বর্বর। তবে একটি কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটানো যেতে পারে।

বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যদি নিরপেক্ষ থাকে, অর্থাৎ দেশটি যদি ন্যাটোতে যোগ না দেয়, তাহলে তার বিনিময়ে রাশিয়া তার বাহিনী সরিয়ে আনতে রাজি হতে পারে। পুতিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে সম্প্রতি টেলিফোনে কথা বলেছেন। সে সময় পুতিন মাখোঁকে বেশ খোলামেলাভাবে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন। পুতিন মাখোঁকে বলেছেন, ‘ইউক্রেনের নিরপেক্ষ এবং সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে বিরত থাকার এটিই প্রথম এবং শেষ সুযোগ। ইউক্রেনকে এটি নিশ্চিত করতেই হবে যে সে কখনোই রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে না।’

পুতিনের কথার মানে দাঁড়ায়, ইউক্রেন যদি নিশ্চিত করে তারা ন্যাটো জোটে যাবে না, তাহলে রাশিয়া অভিযান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে।

কূটনৈতিক দেনদরবারের বাজারে কোনো পক্ষই তার দাবি করা সবকিছু পায় না। সব পক্ষকেই কোনো না কোনো ছাড় দিতে হয়। এ দিক মাথায় রেখেই বুঝতে হবে, পুতিন রুশ সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান ঘটাতে পারবেন না। ইউক্রেনও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও এ বহুমুখী বিশ্বে তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে বাধ্য হবে (এ সত্য চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)।

যদিও মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা এখনই সফল হবে না। এ মুহূর্তে রাশিয়ার ভণ্ডামি দেখে বিশ্ব আতঙ্কিত এবং ইউক্রেনের জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দেখে অভিভূত। এ মুহূর্তে ইউক্রেনের টিকে থাকা (এমনকি বিশ্বেরও) শেষ পর্যন্ত ন্যায়ানুগ বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করছে।

ইউক্রেন আরও যুদ্ধবিমান, আরও ভারী অস্ত্র চাইছে। তারা ন্যাটোকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করতে বলেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ রাশিয়া এবং ন্যাটোর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়াবে, যা শিগগিরই পারমাণবিক শোডাউনের দিকে মোড় নিতে পারে।

ইউরোপীয় ও মার্কিন নেতারা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে পিষ্ট করে ফেলতে চাইছেন। তাঁদের এ মনোভাব রাশিয়ার বর্বরতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক যুদ্ধও গভীর ঝুঁকি ডেকে আনছে। এতে বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্খলন ঘটবে এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধ একটা সময় সামরিক প্রতিক্রিয়ার দিকে গড়াতে বাধ্য। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ চলতে থাকবে। তা ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে এবং সম্ভবত রাশিয়া দখলদারির দিকেই ধেয়ে যাবে।

ইউরোপীয় ও মার্কিন নেতারা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে পিষ্ট করে ফেলতে চাইছেন। তাঁদের এ মনোভাব রাশিয়ার বর্বরতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক যুদ্ধও গভীর ঝুঁকি ডেকে আনছে। এতে বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্খলন ঘটবে এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধ একটা সময় সামরিক প্রতিক্রিয়ার দিকে গড়াতে বাধ্য। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ চলতে থাকবে। তা ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে এবং সম্ভবত রাশিয়া দখলদারির দিকেই ধেয়ে যাবে।

এ অবস্থায় কূটনীতিই একমাত্র সমাধানের পথ। কারণ, কূটনীতি এমনকি চরম সংঘর্ষের মধ্যেও কাজ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, পারমাণবিক যুগে মহাশক্তির বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কূটনীতি অপরিহার্য। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট ছিল তেমনই একটি ঘটনা। ১৯৬১ সালে কিউবায় সরকার উৎখাতের চেষ্টাকারীদের অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র মদদ দিয়েছিল। রাশিয়ার স্বার্থকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ইতালি ও তুরস্কে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্যবস্তু করে কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বকেই তখন পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

শেষ পর্যন্ত একতরফা বিজয়ের মাধ্যমে নয়, বরং কূটনীতি ও সমঝোতার মাধ্যমে উভয় পক্ষের ক্ষোভ প্রশমনে সেই সংকট দূর হয়েছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তুরস্ক ও ইতালি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে আনতে রাজি হয়েছিলেন এবং কিউবায় আর হামলা চালানোর চেষ্টা করবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিউবা থেকে পারমাণবিক অস্ত্র সরিয়ে আনতে রাজি হয়েছিলেন। বিশ্ব বড় বিপর্যয় থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

এখন পুতিনের যুদ্ধের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ রাশিয়াকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা উদ্যোগ নিয়েছে। রাশিয়ার ওপর বহু নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আরও আসছে।

কিন্তু এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি হঠকারী শাসনব্যবস্থাকে কদাচিৎ নিস্তেজ করা যায়। এ ধরনের ব্যবস্থা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকারকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। উত্তর কোরিয়ায়ও তা সম্ভব হয়নি।

তা ছাড়া রাশিয়ার হাতে বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। চীন ও আরও কয়েকটি দেশ এসব পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মানবে না। তাদের সঙ্গে মস্কোর বাণিজ্য চলবে। ফলে রাশিয়াকে যতটা একঘরে করা যাবে বলে ভাবা হচ্ছে, আসলে ততটা সে হবে না। নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কা কেটে গেলে রাশিয়া নতুন নতুন বাজারে ঢুকতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছাড়াও ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া শুরু করেছে। এটি রাশিয়ার ইউক্রেনে প্রবেশ করা ঠেকাতে তো পারবেই না, বরং এটি ইউক্রেনের মাটিকে আফগানিস্তান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার মতো আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী হত্যাপুরীতে পরিণত করতে পারে।

তার চেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টি রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করবে। যেখানে আফগানিস্তান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার হাতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না, সেখানে রাশিয়ার হাতে প্রায় ছয় হাজার পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এর মধ্যে আনুমানিক ১ হাজার ৬০০ পারমাণবিক অস্ত্র পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় এবং বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো মোতায়েন করা অবস্থায় রয়েছে।

আরও পড়ুন

মনে রাখা দরকার, কূটনীতি অনেক সময় ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে একেবারে হাল ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে জন এফ কেনেডি একটি কথা বলেছিলেন, যা বিখ্যাত বাণী হয়ে আছে। কথাটি হলো, ‘ভয় পেয়ে আপসের আলোচনায় বসতে নেই, আবার আপসের আলোচনায় বসতেও ভয় পেতে নেই।’ ভাবনাটি ১৯৬২ সালে বিশ্বকে বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। এটি এখন আবার আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে।

রাশিয়ার পর্যবেক্ষকেরা পুতিনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে বিভক্ত। অনেকে বিশ্বাস করেন, তিনি রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে পুনর্বহাল করতে কোনো কিছুর বিনিময়েই থামবেন না। যদি তাই হয়, ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।

অন্যরা বিশ্বাস করেন, পুতিন ইউক্রেনের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে ও দেশটির অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীল করে তুলতে চান, যাতে ইউক্রেন কখনোই রাশিয়ার জনগণের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে না পারে।

অবশ্য অন্যরা যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, ন্যাটোর সম্প্রসারণ ও ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পুতিনের সোচ্চার বিরোধিতা হিসেবেই এ অভিযান চালানো হয়েছে।

ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান আসলেই শান্তির চাবিকাঠি কি না, তা হয়তো পরীক্ষা করার সময় হয়েছে। এ জন্যই কূটনীতিকে সচল করা দরকার। এটি হয়তো ইউক্রেন এবং বিশ্বকে একটি বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জেফরি ডি স্যাক্স কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রের পরিচালক