বাংলাদেশের কথা জাপানের ভাবা উচিত

অনেক ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পরে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে ঘটনাটির পেছনের অস্পষ্ট নানা কারণ ও যুক্তি ক্রমেই আরও বেশি পরিষ্কার হয়। এক বছর যথেষ্ট সময়। এক বছর আগে ঢাকার গুলশানে সন্ত্রাসবাদী হামলার সংবাদ আমরা যাঁরা জাপানে বসে জানতে পেরেছিলাম, তাঁদের সেটা শোকাহত, অবাক, ক্রোধান্বিত ও আতঙ্কিত করেছিল।

হামলাটি নিছক এক রেস্তোরাঁয় চালানো হলেও এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের, যাদের নাগরিকেরা সেই রাতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন আনন্দের সময় কাটাতে। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় নয়জন ইতালীয় এবং সাতজন জাপানির অন্তর্ভুক্তি পরিষ্কারভাবে সে কথাই বলে। জাপানে এর প্রতিক্রিয়া ছিল সব দিক থেকেই বিষণ্নতায় ভরা এবং বিস্ময়ের। বিষণ্ণতার কারণ অবশ্যই ঘটনার ভয়াবহতা থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া সম্ভব। তবে বিস্ময়টি এসেছে এদিক থেকে যে এশিয়া মহাদেশের বন্ধুপ্রতিম এক দেশে ঘটনাটি ঘটেছে। সন্ত্রাসবাদের রক্তাক্ত হাতের ছোঁয়া যে জাপানকেও এভাবে স্পর্শ করতে পারে, জাপানের অনেকেই এর আগে সেটা কখনো কল্পনা করতে পারেননি।

সন্ত্রাসীদের হাতে জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম নয় এবং সম্ভবত শেষও নয়। মিসর, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ায়ও এর আগে সন্ত্রাসের কোপানলে জাপানকে পড়তে হয়েছে, যার মধ্যে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের রাজধানীতে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা ছিল ভিন্ন অর্থে জাপানের খুব কাছে সন্ত্রাসের চলে আসার ঘটনা। যে জাপানিরা নিজেদের সন্ত্রাসবাদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত মনে করে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিলেন, ঘটনা যেন হঠাৎই ভাবনাহীন সেই সমাজকে জীবনের অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ফলে নড়েচড়ে বসে জাপান হাতড়ে বেড়াতে শুরু করেছে ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের সন্ধান পাওয়ার জন্য এবং সন্দেহের কোপানল অনেকটা যেন বাংলাদেশের ওপর সার্বিকভাবে এসে পড়েছে।

বাংলাদেশকে সরাসরি দায়ী না করলেও এক বছর ধরে জাপান দেশটির ওপর ভ্রমণসংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাংলাদেশ সফর করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেশের নাগরিকদের দিচ্ছে। জাপানের দিক থেকে দেখলে সেটা তেমন বড় কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না হলেও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে মাত্র এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সেটা হচ্ছে বড় এক আঘাত এবং শাস্তিমূলকও বৈকি। এ রকম এক সময়ে বাংলাদেশের সামনে সেই আঘাত এসেছে, যখন কিনা দেশটি মাত্র বলিষ্ঠ অগ্রগতির পথে যাত্রা শুরু করেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ফলে জাপানের সেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত কিন্তু পরোক্ষে হামলাকারীদের ইচ্ছারও প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। কেননা, আমরা জানি দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে বিশৃঙ্খল এক অবস্থা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে দেশীয় এক আল-বাগদাদির উত্থানের মতো পরিবেশ হামলাকারীরা তৈরি করতে চেয়েছিল। আল-বাগদাদি কিংবা মোল্লা ওমরদের আবির্ভাব তো অন্ধকার থেকেই হয়ে থাকে।

অন্যদিকে আবার ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে জাপান মনে হয় গোঁয়ারের মতো বছর ঘুরিয়ে পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষতিও করে চলেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ধরে বজায় থাকা পারস্পরিক বোধগম্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার সূচনা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে। পরবর্তী সময়ে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত হয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রশ্নে দুই দেশের কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করা থেকে। তবে এখন গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর আগের সেই সম্পর্কে ফাটল ধরার বেশ কিছু আভাস ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

গত এক বছরে জাপান দেশের নাগরিক খুন হওয়ার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে জড়িত থাকা অবস্থা থেকে সরকারিভাবে যতটা পিছিয়ে গেছে, চীন উল্টোভাবে সেই শূন্য স্থান পূরণ করে নিতে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে গেছে। ঢাকার পথে-ঘাটে আজকাল জাপানি উপস্থিতি চোখে না পড়লেও চীনাদের সেখানে কিন্তু ভালোই দেখা যায়। কারও কারও মনে তাই সে রকম প্রশ্ন দেখা দেওয়া মনে হয় স্বাভাবিক যে জাপানের ছেড়ে দেওয়া জায়গা চীন দখল করে নিচ্ছে কি না। সে রকম কিছু হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে বলা যায় ভ্রমণ সতর্কতা বজায় রেখে জাপানের লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই হচ্ছে বেশি।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের এই আচরণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টোকিওর পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেও সম্ভবত আরও কিছুটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরছে। কেননা, আমরা জানি এবং জাপানেরও অনেকেরই অজানা নয় যে জাপানি নাগরিক বলেই এক বছর আগে এঁদের চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়নি। বরং হত্যাকারীরা চেয়েছিল বিদেশিদের যেকোনো এক বড় সমাবেশে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে প্রচারণা পেতে। ঠিক সেভাবেই ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্সের সন্ত্রাসবাদীরা বড় শহরগুলোর সমাবেশকে বেছে নিতে পছন্দ করে প্রচার লাভের আশা থেকে এবং সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে তা তারা পেয়েও যায়। ফলে কোনো দেশ তো বলছে না তাদের নাগরিকেরা যেন একেবারে প্রয়োজন না হলে ইউরোপের বড় শহরগুলোর দিকে পা না বাড়ায়, যদিও সবাই আমরা জানি যে সেখানে সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা ফাঁদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে কেন বাংলাদেশের বেলাতেই সন্ত্রাসবাদের ঘটনা দেশের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে?

কথা হচ্ছে সম-অধিকার এবং সমতার কথা আমরা ওপরে বলে গেলেও মানবসমাজ এখনো মনের ভেতরে বসে থাকা সে রকম বৈষম্য দূর করতে পারেনি। সময় এবং সুযোগ হলেই মনের ভেতরে সযত্নে বসে থাকা বৈষম্যের সেই বীজ উঁকি দিয়ে জানান দেয় এর উপস্থিতির কথা। ট্রাম্প সাহেবদের মতো কুছপরোয়া নেই গোছের রাজনীতিবিদেরা সেটা করেন প্রকাশ্যে এবং ঘোমটার ঘেরাটোপে আত্মপরিচয় ঢেকে রাখা রাজনীতিবিদেরা সেই একই কাজ করেন অন্য কিছুর দোহাই দিয়ে। হোলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ঘটনার এক বছর পর মনে হয় পেছনের এ রকম অনেক হিসাব–নিকাশ আরও বেশি স্পষ্ট করে আমাদের সামনে তুলে ধরছে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক  সাংবাদিক