বিউটি পারলারের গারো মেয়েরা ভালো নেই

গারো মেয়েটির বাড়ি সুনামগঞ্জের মুগাইপাড় গ্রামে। এই গ্রাম আমি তাকে দেখেছিলাম অনেক বছর আগে। আষাঢ় মাসে। মেঘালয়ের সীমান্তঘেঁষা গ্রাম। পাহাড় থেকে নেমে গ্রামের ভেতর দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। ভারত তার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। তবু গারো পাহাড়ের কোলে গ্রামটি সবুজ সুন্দর। বর্ষাকাল ছিল বলে সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। এমনিতে মেঘালয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

মেয়েটি আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করেছিল ৭ মে সকালে। ধরে নিই মেয়েটির নাম অনামিকা সাংমা অথবা বাসন্তী মারাক। মেয়েটি বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। তবু আমি নাম জেনে নিলাম। মেয়েটি শুনেছে, আমি ঢাকায় বিউটি পারলারে কর্মরত মেয়েদের সাহায্য করি। পরে জানলাম, মেয়েটি থাকে ফার্মগেট এলাকায়। হলিক্রস কলেজের কাছে তার ছোট একটি বিউটি পারলার আছে। এখন করোনার গ্রাসে তার করুণ দশা। মার্চ মাস থেকে পারলার বন্ধ। এখন মে মাস। এই মাসে কোনো সম্ভাবনা সে দেখছে না পারলার খোলার। আর পারলার খুললেও কাস্টমার কেউ আসবে বলে তার মনে হয় না। আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, পরিবারে কে কে আছেন? স্বামী কী করেন? প্রশ্নটা অতিরিক্ত দ্রুত হয়ে গেল বলে মনে হলো। কিন্তু জানতে পারলে ভালো হয় যদি স্বামীর রোজগার থাকে, তবে এই দুর্যোগে সহায়ক হয়।

মেয়েটি বলল, বিয়ে হয়নি তার। মেয়েটিকে একটু লজ্জিত হলো বলে মনে হলো কথার সুরে। জানলাম, তার পারলারে কাজ করে আরো তিন গারো মেয়ে। তাদের নাম কবিতা হাদিমা, মারিয়া মাজি ও পাথুরী রেমা। আমি বললাম, কেমন চলত তোমার পারলার? মেয়েটি বলল, মোটামুটি আয়–রোজগার হতো। চলে যেত। সঞ্চয় থাকত না তেমন কিন্তু মেয়েটি ও তিন কর্মী মাসের শেষে তাদের পরিবার, বাবা-মা, ভাইবোন ও স্বজনদের টুকটাক আর্থিক সাহায্য করতে পারত। বছরে অন্তত এক–দুবার। বিশেষ করে বড়দিনের সময়। কারও কোনো সাহায্য ছাড়া, এই কঠিন নগরীতে এসে সীমান্তঘেঁষা একটি গ্রাম থেকে ছোট ব্যবসা চালাচ্ছিল সে। চলছিল বেশ। এখন করোনার কারণে সামনে অনিশ্চিত অন্ধকার সময় তার।

ঢাকার একটি বিউটি পারলারের একটি শাখাতেই দুই শর বেশি গারো মেয়ে কাজ করে। আমার গ্রাম সংড়া-আসকিপাড়ার মেয়েও আছে এই পারলারটিতে। এসব পারলারের সঙ্গে গারোদের সম্পর্ক এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে গারোদের উৎসব অনুষ্ঠানে পারলারের কাছে তরুণেরা আর্থিক সহযোগিতা নিঃসংকোচে চাইতে পারে। অসংখ্য গারো পরিবারের দিন বদলে গেছে এই বিউটি পারলারগুলোর কারণে। এই মেয়েরা নিজেরা সুন্দর–পরিচ্ছন্ন থাকে। সেজেগুজে পরিপাটি ওরা। একটি গল্প বলি। অনেক দিন আগের ঘটনা। আমাদের গ্রামে শীতকালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। আমিও ছিলাম ওই অনুষ্ঠানে। পৌষ মাসে সকালবেলা বিয়ের জন্য সব প্রস্তুত। বধূকে সাজানো হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। বিউটিশিয়ানের তো অভাব নেই। অনেকে ছুটিতে এসেছে বড়দিন উপলক্ষে। বধূ যখন সেজেগুজে ঘর থেকে বের হলো, স্বয়ং তার বাবা তাকে চিনতে পারল না। পুতুলের মতো সুন্দর বধূ বসে আছে উঠানে, আর বধূর বাবা তাকে খুঁজছে। পারলারের মেয়েদের নিয়ে এ রকম অনেক গল্প আছে।

এর মধ্যে অনেক মেয়ে চলে গেছে গ্রামে। কেউ কেউ রাতের অন্ধকারে গেছে। আমি খবর নিয়ে জানলাম, যেসব মেয়ে গ্রামে চলে গেছে, তারা অনেকে বেতন পায়নি মার্চ মাসের। এখন মে চলছে। আমি মনে মনে আশা করি এই মেয়েরা যেন সকলে মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন হাতে পায়। কোনো কোনো বড় পারলার তার কর্মীদের বেতন দিয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি ধরনের পারলারের মালিকদের অবস্থা শোচনীয়। এই মেয়েরাই আমাকে বলেছে, এপ্রিল আর মে মাসের বেতন অসম্ভব। এটি কীভাবে সম্ভব? কেননা পারলার তো চলছেই না প্রায় দুই মাস। পারলার চালানোর খরচ আছে। বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির খরচ আছে। ভ্যাট-ট্যাক্স তো আছেই।

বিজিএমইএসহ বড় বড় সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা চাইছে, পাচ্ছেও। এই যে বিউটি পারলার, ডেইলি স্টার–এর এক রিপোর্টে আমি পড়েছিলাম, প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এখানে। তারা সরকারের কোনো সহায়তা ছাড়াই রাষ্ট্রকেই সহায়তা করছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে। কত পরিবারের সুখ-আনন্দ এর সঙ্গে জড়িত, তাদের পাশে এবার সরকার দাঁড়াক। আমার বিনীত অনুরোধ সরকার এই উপেক্ষিত, অস্বীকৃত, অনালোচিত অথচ সম্ভাবনাময় ও নিজের শক্তিতে চলমান বিউটি পারলারের গারো মেয়েদের পাশে দাঁড়াক। বিশেষ করে নারীদের জন্য, যার উদ্যোক্তা প্রায় সবাই নারী, বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করুক। সরকার যা এখনই করতে পারে তা হলো, এদের ভ্যাট-ট্যাক্স কয়েক মাসের জন্য মওকুফ করা, যাতে তারা আবার উঠে দাঁড়াতে পারে।

নিজের উদ্যোগে ছোট পারলার চালানো ওই গারো মেয়েটির কথা আমি বলছিলাম। মেয়েটি তার কর্মী কবিতা হাদিমা, পাথুরী রেমা ও মারীয়া বাজির নম্বর আমাকে পাঠাল। আশায় বুক বাঁধি, তারা নিশ্চয় আবার উঠে দাঁড়াবে। কঠিন সংগ্রাম, অসীম সাহস ও মনোবল নিয়ে করোনাকে পরাজিত করে হেসে উঠবে তারা। আবার এক মুখরিত মুকুলিত আলো ঝলমল দিন আমরা ফিরে পাব। আমি নতুন করে অনুভব করলাম এই পৃথিবীর মানুষ অনেক মানবিক, সহৃদয়, কোমলমতি আর সংবেদনশীল। আমস্টারডাম থেকে আমার দুই প্রফেসর বন্ধুসহ অনেকে মিলে আমরা এই মেয়েদের জন্য একটু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনও তাদের কথা ভাবছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নগরের হৃদয়বান মানুষেরা পাশে দাঁড়িয়েছেন ভালোবেসে, পরম মমতায়। আমাদের এই দেশ, এই পৃথিবী কত সুন্দর? আমি অবাক হই, কত মানবিক গল্প এখানে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে?

সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী