যে কারণে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ‘ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলায়’ ফিরল

সব মিলিয়ে গত তিন দিনে যা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাই মূলত মার খেয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

হারি আপ ব্রাদার! লেকচার আমি দেব না। লেকচার আমি দিতে আসি নাই। তবে ভাইয়া, মারামারি, ধাওয়াধাওয়ির অভাবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ম্যালা দিন ধরে নিরামিষ মার্কা নন–পলিটিক্যাল জিনিস হয়ে পড়ে ছিল, সেইখান থেকে তার ফিরে আসা এবং ক্যাম্পাসে আঁতকা শুরু হওয়া লাঠিখেলা নিয়ে দুই-চারখান কথা বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। উল্টাপাল্টা বলে ফেললে জায়গায় দাঁড়িয়ে হকিস্টিক উঁচিয়ে আওয়াজ দেবেন, জায়গায় গিয়ে ‘সরি’ বলে চলে আসব।

দাদাভাই, ওয়ান্স আপন এ টাইম, এই ক্যাম্পাসে ম্যালা দল ছিল, দলাদলি ছিল। এরশাদের আমল থেকে এখানে বহু ‘শান্তিপূর্ণ’ মারামারি হয়েছে। বহু জখম-মার্ডার হয়েছে। বিএনপির সর্বশেষ সরকারের সময় থেকে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দফার সরকারের আমল পর্যন্ত।

ক্যাম্পাসে যথেষ্ট উৎসবমুখর মিছিল-মিটিং ও গুলি-গোল্লা হয়েছে। প্রগতিশীল থেকে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন এই ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল–মিটিং করত। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদলের সকাল-বিকেল মারামারি বাধত। হকিস্টিকের বাড়িতে অমুকের মাথা ফাটত, তমুকের পা ভাঙত। মাঝেমধ্যে গুলি-পটকা ফুটত।

গত কয়েক বছর ছাত্রদল-ছাত্রলীগের সেই সব ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা দেখা যাচ্ছিল না। আসলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ বাদে আর কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। ছাত্রদলকে যা-ও দেখা যাচ্ছিল, তা–ও ওই ঝটিকা মিছিল পর্যন্ত। ‘সরকার ফেলে দেওয়া কোনো ঘটনা নয়’ এবং ‘আগামী ঈদের পর সরকারের খবর আছে’—এই ধরনের ভাষণ দুই মিনিটে হুড়মুড় করে শেষ করে তিন মিনিটের একটা চ্যাতা মিছিল নিয়ে তারা ক্যাম্পাসে বার কয়েক নেমেছে। খবর পেয়ে ছাত্রলীগ ‘শান্তি রক্ষা মিছিল’ নিয়ে এসেছে। শান্তি–শৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে ছাত্রদল টুক করে সটকে পড়েছে। ফলে ঢাবি ক্যাম্পাসে বহুদিন রাজনৈতিক লাঠিখেলা হয়নি। সেখানকার পরিবেশটা অনেক দিন ‘ছায়া সুনিবিড়-শান্তির নীড়’ টাইপের হয়ে পড়েছিল।

অতি আমোদের কথা, গেল মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতির হাওয়া-বাতাস ফুরফুর করে বইতে শুরু করেছে। সেখানে এক দল মিছিল বের করছে। আরেক দল ধাওয়া মারছে। এক দল ইট মারছে। আরেক দল পাটকেল ফেরত দিচ্ছে। খালি ইট-পাটকেলে বিষয়টা আটকে থাকছে না। জলজ্যান্ত মানুষকে সাপ মারা কায়দায় মেরে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। গতকালও সেখানে ব্যাপক হারে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে।

ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো ভিডিওতে দেখা গেছে, ছাত্রদল ‘গণতন্ত্র বাঁচানোর জন্য’ মিছিল নিয়ে বের হয়েছে। ছাত্রলীগ আর দেরি করেনি। তারাও ‘গণতন্ত্র বাঁচানোর জন্য’ হেলমেট-টেলমেট পরে হকিস্টিক হাতে নেমে ধাওয়া মেরেছে। ছাত্রলীগের জনা দশেক ছেলে (তাঁদের সঙ্গে লাঠি হাতে কয়েকজন মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে) ছাত্রদলের একজনকে ধরে ফেলে ‘দুর্বল হার্টের লোকজনের পক্ষে এই দৃশ্য দেখা ঠিক হবে না’— কায়দায় পেটাচ্ছে। পরে তাঁকে আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ছিল বুধবার। ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’—কবির এই লাইনের মর্মবাণী ওই দিন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর মন ছুঁয়ে গেছে। কবির জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাঁরা ওই লাইনের মর্মার্থ হাতে-কলমে দেখিয়েছেন। ছাত্রদলের এক নারী কর্মীকে তাঁরা এমনভাবে পিটিয়েছেন, যা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেছে, তাঁদের ‘চক্ষে পুরুষ–রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’ অবশ্য ছাত্রদলের সেই নারী কর্মীও মার খাওয়ার আগে যেভাবে ছাত্রলীগের দিকে ইট–পাটকেল ছুড়ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, তিনিও নজরুলের সাম্যবাদী অমর লাইনটির একনিষ্ঠ সমর্থক। কারণ, তিনি তো জানেনই, নজরুলও তাঁর মতো ছাত্রদল করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল।’

যা হোক, সব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে যা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাই মূলত মার খেয়েছেন। ছাত্রলীগ অবশ্য এটিকে মারামারি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন অত্যন্ত সুললিত ভাষায় ছাত্রদলের ওপর চালানো হামলাকে ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, রাজাকারদের তল্পিবাহক ও সন্ত্রাসের ডিস্ট্রিবিউটর ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল তাদের সহিংস সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বিঘ্নিত করছে। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য নিতান্ত দায়ে পড়ে সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ প্রতিবাদের চোটে ছাত্রদলের অনেক ছেলেপেলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সব মতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা কীভাবে হেলমেট পরে–টরে প্রতিক্রিয়াশীল গণতন্ত্র চর্চাকারী হয়ে গেলেন, সে বিষয়ে অবশ্য সাদ্দাম কিছু বলেননি।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ছাত্রদলের হাতে আচমকা কী এমন ‘পাওয়ার’ এল, যার জোরে তারা ঢাবি ক্যাম্পাসে মিছিল করতে, এমনকি ছাত্রলীগের সঙ্গে লাঠিখেলায় নামতে পর্যন্ত বল পাচ্ছে? এই শক্তি তো অল্প কিছুদিন আগেও দেখা যায়নি। গত কয়েক দিন বিএনপির নেতারাও শক্ত শক্ত কথা বলছেন। এই বল কে দিয়েছে? কে দিয়েছে? কে? এর পেছনে কি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাত আছে?

গেল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে’ আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপির লোকজন আর ঘুমের গান গাইবেন না। প্রেমের গানও গাইবেন না। তাঁরা গাইবেন জেগে ওঠার গান। সেখানে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা পড়ে মনে হলো, তিনি দরকার পড়লে কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সুর বসিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে সেই গান গাওয়াবেন। সেখানে তিনি নেতা–কর্মীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমরা যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আসুন আমরা সেই গান একসঙ্গি গাই—বল বীর— /বল উন্নত মম শির। আর কোথাকার সেই ঘুমের গান এবং প্রেমের গান দিয়ে এখন হবে না, এখন জেগে ওঠার গান গাইতে হবে।’

বিএনপিকে রাজপথে নামতে বাধা না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের এখন ক্ষতি নাকি লাভ বেশি? আমার তো মনে হয়, লাভই বেশি। নির্বাচনের যেহেতু বেশি দেরি নাই, সেহেতু ‘দেশে গণতন্ত্র নাই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, মিছিল-সমাবেশের স্বাধীনতা নাই’—এই অভিযোগ সরকারের জন্য দ্রুত মুছে ফেলা দরকার। তার জন্য দেশে একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাব আনা দরকার।

ওই একই দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক মানববন্ধনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আরও মারাত্মক কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁরা হাত আর পকেটে রাখবেন না। তাঁদের হাত থাকবে ওপরে। অর্থাৎ হাতাহাতির জন্য তিনি কর্মীদের হাত মশকো করতে বলেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলা ‘প্রতিরোধের’ জন্য ছাত্রদলের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘এখন থেকে আঘাত এলে পাল্টা প্রতিরোধ করতে হবে, আঘাত করতে হবে। এই আঘাত করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশকে স্বাধীন করেছি, অন্যায়ভাবে মাইর খাওয়ার জন্য না। আমাদের মাইর দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে।’ গয়েশ্বর বলেন, ‘আমাদের ওপর হাত তোলেন, আমাদের হাত আর পকেটে থাকবে না।’

আমার সন্দেহ, বিএনপির এই হাত পকেটের বাইরে রাখার বলবর্ধক হিসেবে কবি কাজী নজরুল নন, এর পেছনে আসলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি ঘোষণার হাত আছে। ৭ মে রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের ব্যাপারে নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বলেছেন, তারা মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করুক। তারা স্বাধীনভাবে করুক। আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।’

আরও পড়ুন

ওবায়দুল কাদের এ কথা বলার পর থেকে বিএনপির মধ্যে বেশ বল দেখা যাচ্ছে। ছাত্রদলও রাস্তায় নামছে। পুলিশ তাদের আগের মতো ধরপাকড় করছে না। অর্থাৎ, সরকারবিরোধী মিছিল–মিটিং করলে ফট করে পুলিশ এসে ধরবে না—এই বিশ্বাস তারা পাওয়া শুরু করেছে। এই বলে তাদের হাত ‘পকেটের বাইরে’ আসতে শুরু করেছে।

কিন্তু হাজেরানে মজলিশ, মাথা খাটিয়ে বলেন তো, হঠাৎ কী এমন হলো, যাতে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এত ‘স্পেস’ দেওয়া শুরু করল? এইটা কি আওয়ামী লীগের নতুন চাল?

বিএনপিকে রাজপথে নামতে বাধা না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের এখন ক্ষতি নাকি লাভ বেশি? আমার তো মনে হয়, লাভই বেশি। নির্বাচনের যেহেতু বেশি দেরি নাই, সেহেতু ‘দেশে গণতন্ত্র নাই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, মিছিল-সমাবেশের স্বাধীনতা নাই’—এই অভিযোগ সরকারের জন্য দ্রুত মুছে ফেলা দরকার। তার জন্য দেশে একটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাব আনা দরকার।

বিরোধীরা যদি মিছিল–মিটিং করতে পারে, তারা যদি মাঝেমধ্যে দু–একটা পাল্টা ধাওয়া দিতে পারে, তাহলে তাদের মনে বল আসবে। সেই বল তাদের এই সরকারের অধীনেও নির্বাচনে নেওয়ার লোভ দেখাতে পারে। আন্দাজ করি, সেই কারণে আওয়ামী লীগ বলছে, ‘আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।’ আর তা–ই শুনে বিএনপি বলছে,‘আমাদের এখন ঘুমের গান বাদ দিয়ে জেগে ওঠার গান গাইতে হবে।’ সেই বলেই কি ছাত্রদল ‘জেগে ওঠার গান’ ধরেছে?

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    ই–মেইল: [email protected]