লাদাখে ভারত-চীন সংঘাতের দুই বছর পর উষ্ণতা বাড়ছে

লাদাখ সংঘর্ষের দুই বছর পর ভারত–চীন দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে
ছবি: রয়টার্স

ঠিক দুই বছর আগে, ২০২০ সালের জুন মাসে পশ্চিম হিমালয়ের লাদাখে চীন ও ভারতের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া লড়াইয়ে দুই পক্ষের সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের মৃত্যু হয়। দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। মনে করা হয়েছিল, সংঘাত আরও গভীর হবে, এশিয়ার সংকটও বাড়বে। হয়নি। লাদাখ সংঘর্ষের ঠিক দুই বছর পর দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি তো হয়ইনি, উন্নতি হয়েছে।

সম্প্রতি তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার এক নিরাপত্তা সম্মেলনে রাশিয়া, ইরানসহ মধ্য এশিয়ার একাধিক ছোট দেশের সঙ্গে এক বিবৃতিতে সই করে ভারত ও চীন। আফগানিস্তান-পরবর্তী নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে পরস্পরের নিরাপত্তাবিষয়ক উদ্বেগ নিয়ে দুই দেশ একমত হয়। এর ঠিক আগে, মার্চ মাসে দিল্লি সফর করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। সফরের পর দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, তিনি ওয়াং ইর সঙ্গে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় এবং ২০২১ সালের জুলাই মাসে দুশানবেতে দেখা করেন। স্বাভাবিকভাবেই কীভাবে সীমান্তে উত্তেজনা কমানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার পর্যায়ে কথাবার্তা ভালোভাবেই এগোচ্ছে বলেও তিনি জানান। জয়শঙ্করের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, ভারত ও চীনের সম্পর্কের অবনতি হয়নি।

ভারত ও চীনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অংশ নিয়ে বিবাদ। এর কিছুটা পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশে, যা দক্ষিণ তিব্বতের অংশ বলে চীন দাবি করে। মধ্যের অংশটি নেপাল এবং ভুটানের মধ্যবর্তী প্রায় ৮০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এবং উত্তর ভারতে পশ্চিম হিমালয়ের কোল ঘেঁষে ভারতশাসিত লাদাখ এবং চীনশাসিত আকসাই চীনের মধ্যবর্তী অংশ। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ২০১৯ সালের আগস্টে প্রত্যাহার করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর ও আকসাই চীনকে ভারতের সঙ্গে জোড়া হবে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিল। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার সপ্তাহ কয়েকের মধ্যেই বেইজিংয়ে উড়ে যান জয়শঙ্কর। ওয়াং ইর সঙ্গে দেখা করেন। লাভ হয়নি। চীন ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে এবং শেষ পর্যন্ত সংঘাতে ভারতের ২০ এবং চীনের কয়েকজন আর্মি সদস্যের প্রাণ যায়। ভারতে প্রবল চীনবিরোধী হাওয়া তৈরি হয়, হিন্দুত্ববাদী নানা দল মাঠে নামে এবং সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। প্রতিশোধ নেওয়া দূরে থাক, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনের বিরোধিতায় একটি কড়া শব্দও ব্যয় করেননি।

ভারতের পর্যবেক্ষক এবং নীতিনির্ধারকেরা মোটামুটি একমত যে কিছু সমস্যা বাদ দিলে আগামী দিনে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সার্বিক উন্নতিই হবে, অবনতি নয়। বস্তুত অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতে ভারত যদি চীনের সঙ্গে তার অতীতের সমস্যার অর্থাৎ সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেই সমাধান না হলেও আগামী দিনে লক্ষ্য হবে, সমস্যার বাস্তবতা স্বীকার করেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক আদান-প্রদান আরও বাড়ানো। এটা একটা নতুন অধ্যায়।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আমেরিকার আর্মির দায়িত্বে থাকা জেনারেল চার্লস ফ্লিনের সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং চীন ও ভারতের প্রতিক্রিয়া। ফ্লিন ভারত সফরে এসে সপ্তাহখানেক আগে বলেছিলেন, চীনের লিবারেশন আর্মি যেভাবে সীমান্তে পরিকাঠামো বানাচ্ছে, তা ‘উদ্বেগজনক’। ফ্লিনের মন্তব্যের পাল্টা জবাব না দিয়ে ভারত বলেছে, সীমান্ত সুরক্ষিত করতে ভারত ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নিয়েছে। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে, আমেরিকার কিছু প্রতিনিধি দুই দেশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এটা নিন্দনীয়। দিল্লি ও বেইজিং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে দ্বিপক্ষীয় স্তরে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।

এ ঘটনাক্রম প্রমাণ করে, বেইজিং ও দিল্লি সম্পর্ক মেরামতে যতটা সময় দিচ্ছে, বিরোধ বাড়াতে ততটা নয়।

কেন চুপ থাকল ভারত?

এর অনেক কারণের মধ্যে তিনটি এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।

ভারতের মূলত মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল। কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য দুটোই ভারতে আসে, যা দেশের বা বিদেশের বাজারে বিক্রি করেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা উত্তরোত্তর বেড়েছে। গত দশকজুড়ে বারবারই দেখা গেছে ভারতের ১ নম্বর ব্যবসায়িক সহযোগী আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীন। এটা জাতীয়তাবাদীদের চুপচাপ থাকার প্রথম কারণ।

দ্বিতীয়ত, চীনের সামরিক বাজেট বরাদ্দ ২৯৩ বিলিয়ন ডলার, ভারতের প্রায় চার গুণ। ভারতের বরাদ্দ ৭৬ বিলিয়ন ডলার। এ তথ্য ২০২১ সালের, দিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

তৃতীয়ত, সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে সরকার সম্প্রতি জানিয়েছে, ভারতের যেসব পণ্য সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে যায়, তার ৫৫ শতাংশ যায় দক্ষিণ চীন সাগর এবং মালাক্কা প্রণালি দিয়ে। চীনের নৌবহরের আয়তন ও প্রভাব যে দক্ষিণ চীন সাগরে দিল্লির জন্য বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে, সংসদের বিবৃতি থেকেই সেটা স্পষ্ট।

আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কে শীতলতার বৃদ্ধি

পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে শীতলতা বাড়ছে। সম্প্রতি (৩ জুন) স্লোভাকিয়ার ব্রাতিশ্লাভায় জয়শঙ্কর স্পষ্ট জানিয়েছেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে ইউরোপ ও আমেরিকার নির্দেশ মেনে চলা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।

ইউরোপ রাশিয়ার ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে দেশের মানুষের স্বার্থকে সুরক্ষিত করে। যদি ইউরোপীয় দেশ, পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকা রাশিয়াকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ থেকে তেল কেনার পরামর্শ দেয়, তাহলে তাদের উচিত ইরানের তেল বাজারে আসতে দেওয়া, বলেন জয়শঙ্কর। ভেনেজুয়েলার তেলও বাজারে আসতে দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। ভারত যাতে রাশিয়া থেকে তেল না কেনে, তার জন্য দিল্লির ওপর চাপ বাড়াচ্ছিল আমেরিকা ও ইউরোপ। তাৎপর্যপূর্ণ, গত সপ্তাহে জয়শঙ্করের সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেন আমির আবদুল্লাহিয়া।

গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে ভারতের তেলের চাহিদা ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ভারতের তেল প্রয়োজন। জয়শঙ্কর বলেন, এ প্রশ্নের কোনো ভিত্তি নেই যে ভারতের টাকায় যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। ‘শুধু ভারত তেল কিনলেই, সেই অর্থ যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে? ইউরোপ যে গ্যাস রাশিয়া থেকে কিনছে, সেই টাকা কি যুদ্ধে খরচ হচ্ছে না?’ প্রশ্ন জয়শঙ্করের। চীন প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে সমস্যা আছে। ভারত সে সমস্যার সমাধানে সক্ষম। আন্তর্জাতিক সমর্থন অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে একটি সমস্যার সমাধান করতে দ্বিতীয় সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমাদের ওপর চাপ বাড়ানো হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের সমস্যার সঙ্গে ইউক্রেন বা রাশিয়ার সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই।’ ইউরোপের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত যে তাদের সমস্যা গোটা দুনিয়ার সমস্যা, কিন্তু বিশ্বের সমস্যা ইউরোপের নয়, বলেন জয়শঙ্কর।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকার পরমাণু শক্তিচালিত আক্রমণাত্মক সাবমেরিন ভারতকে বিক্রি না করে অস্ট্রেলিয়াকে বিক্রি করা, ওয়াশিংটনের বারবার ভারতের সংখ্যালঘু সমাজের মানবাধিকার হরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তোলা বা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সখ্য—এসবের কোনোটার জন্য ভারতের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে, তা বলা মুশকিল। আবার এমনও হতে পারে আফগানিস্তান- ইউক্রেনের পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বকূটনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন করছে।

নতুন পররাষ্ট্রনীতি

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময় ভারত ‘নন-অ্যালাইনমেন্ট’ বা সবার সঙ্গে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি নিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে অতীতে কখনো প্রভাব বিস্তার বা অন্য দেশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা তারা করেনি। মোটামুটিভাবে সব সময়ই ভারত কখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার কখনো বা আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা এবং আদান-প্রদানের কূটনীতির মধ্য দিয়েই এগিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদির আমলে এর পরিবর্তন যে ঘটেছে, তা জয়শঙ্করের লেখায়ই পরিষ্কার। তিনি ২০২০ সালে একটি বই লেখেন, দ্য ইন্ডিয়া অ্যাহেড। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। ভারত দুই দিকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। অতীতেও পারত, কিন্তু পারেনি। কারণ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরাট ছায়া ভারতের ওপর পড়েছিল। কিন্তু চীন দেখিয়েছে, কোনো বৃহৎ ও উন্নয়নশীল দেশ যার অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান, সে আরও বড় দায়িত্ব নিতে পারে। চীন যে রাস্তায় হেঁটেছে, ভারত সেই রাস্তায় হাঁটতেই পারে, অবশ্যই নিজের গতিতে,’ জানিয়েছেন জয়শঙ্কর। আমেরিকা আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে বলেও মন্তব্য করে জয়শঙ্কর বইয়ে লিখেছেন, ভারতের মতো দেশ এবং অন্যান্য মাঝারি শক্তির দেশের জন্য সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কারণ, মাল্টিপোলার (বহু মেরুর) বিশ্বের জন্ম হচ্ছে। এ অবস্থায় আমেরিকা-ইউরোপকে বাদ দিয়ে ভারত সরাসরি চীনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে এবং চীনও তা-ই চাইছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, সেই কারণে লাদাখের সংঘাতকে বাড়ায়নি কোনো পক্ষই।

আরও পড়ুন

ভারতের পর্যবেক্ষক এবং নীতিনির্ধারকেরা মোটামুটি একমত যে কিছু সমস্যা বাদ দিলে আগামী দিনে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সার্বিক উন্নতিই হবে, অবনতি নয়। বস্তুত অনেকেই মনে করছেন, ভবিষ্যতে ভারত যদি চীনের সঙ্গে তার অতীতের সমস্যার অর্থাৎ সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে ফেলে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেই সমাধান না হলেও আগামী দিনে লক্ষ্য হবে, সমস্যার বাস্তবতা স্বীকার করেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক আদান-প্রদান আরও বাড়ানো। এটা একটা নতুন অধ্যায়।

এ অধ্যায় যদি দিল্লি ও বেইজিং নিজের মতো করে লিখতে পারে, তবে একুশ শতক যে এশিয়ার হবে, তা নিয়ে পূর্ব-পশ্চিম কোনো বিশ্বের কূটনীতিবোদ্ধারই সন্দেহ নেই। কারণ, ভারত ও চীন মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ শ্রমশক্তি ও বাজার রয়েছে এই দুই দেশেই।

  • শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা