শহরবানুর স্বদেশ ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

ক্ষতিগ্রস্ত সুরসম্রাট দ্য আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন
ক্ষতিগ্রস্ত সুরসম্রাট দ্য আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন

এখন শীতকাল। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে মাঘ মাস। কিন্তু পৌষের শেষে ১১ জানুয়ারির বেলা দেড়টার গরমে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভেতরে বসে বসে শরীর ঘামছিল। গতিময় থাকলে বাতাসের পরশ পাওয়া যায়, কিন্তু রাজধানী শহর ঢাকার বিবমিষা জাগানো যানজট স্বস্তির সবটুকু আত্মসাৎ করছিল সেদিন। সাধারণত, হাতিরঝিল হয়ে পান্থপথ আসতে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের ট্রাফিক সিগন্যালে ন্যূনতম ২০ মিনিট নিথর বসে থাকতেই হয়।
কিন্তু সেদিন সময় থমকে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উদ্যাপনে আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে জনসভার আয়োজন করেছিল, সে সভায় যোগ দিতে বাস-ট্রাক ও মিনিবাসভর্তি দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা ফার্মগেট থেকে শাহবাগমুখী গন্তব্যে স্লোগান দিতে দিতে চলছিলেন আর আমজনতা রাস্তায় আটকে গিয়েছিল। আমজনতার গন্তব্য দূরে অথবা কাছেই হোক, অনেকেই বাহন ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোকেয়া চৌধুরী সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।
ঠিক তখন তিনি এসে অটোরিকশার ধাতব খাঁচার সঙ্গে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছে তাঁর। মাথার চুলগুলো চোখধাঁধানো সাদা। প্রসারিত করতলে বলিরেখা, শূন্যতা ও আকুলতা। এই মানুষদের, এখানে, একটাই চাওয়া। আর্থিক সাহায্য। স্থূল ভাষায় ভিক্ষা। বরাবরের মতো কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী নাম আপনার?’ ফোকলা দাঁতের মুখ থেকে উত্তর আসে, ‘শহরবানু’।
আমার জিজ্ঞাসা বিস্তার নেয়। ‘এখানে কই থাকেন?’
‘থাকার কুনো জাগা নাই বাজান। রাস্তাত থাহি।’
অসহায় বোধ আমাকে জড়াতে থাকে। এই শহরে এখন তাঁর থাকার কোনো জায়গা নেই, তা যদি সত্যিও হয়, একটা সময় নিশ্চয়ই তিনি কোথাও ছিলেন। নিশ্চয়ই তাঁর স্বামী-সন্তানসন্ততি ছিল। সংসার ছিল। কোথায় ছিল? ‘নেত্রকোনা বাড়ি আছিল বাজান। আর স্বামী মরছে সংগ্রামের বছর।’ বাস-ট্রাকভর্তি স্লোগানমুখর মানুষ যাচ্ছে হাসিমুখে, করতালি বাজাতে বাজাতে। শহরবানুর অনেক তাড়া। আমাদের অটোরিকশার পাশেই আটকে থাকা চকচকে গাড়িটার দিকে এগোলেন তিনি। আমার মনে পড়ে যায়, সংগ্রামের বছর মানে ১৯৭১ সাল। শহরবানুর স্বামী সে বছর মারা গেছেন। কীভাবে? যুদ্ধে গিয়েছিলেন কি শহরবানুর স্বামী? জানা হয় না। মগজে অঙ্ক কষি। ৪৪ বছর এই নারী একা। বান্ধবহীন। ঝা-চকচকে শহরে শহরবানু এখন ভিক্ষুক।
৪৪ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিষয় মীমাংসা হয়েছিল: আমাদের প্রত্যাশার, স্বপ্নের এবং জীবনবোধের। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালি, এই সম্প্রীতিবোধ সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানি ২২ পরিবারের শোষণ-লুণ্ঠন আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আমাদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনরাত একাকার করেছিল। কথা ছিল অনেক। স্বদেশে, স্বদেশির হাতে আর কেউ নির্যাতিত হবে না। অসম্মানিত হবে না। অধিকারহীন হবে না। সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। ধর্মের অপব্যবহারে কুৎসিত রাজনীতির দাবা খেলা হবে না। মত প্রকাশিত হবে স্বাধীনভাবে। নারীর অসম্মান হবে না। কেউ ক্ষুধার কষ্ট পাবে না। সমাজ হবে বৈষম্যহীন। সংবিধান হবে সব মানুষের রক্ষাকবচ। জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহি করবেন সাধারণের কাছে।
মুক্তবুদ্ধির কান পেতে আমরা শুনব রবীন্দ্রনাথ আমাদের বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছেন। পথের বাঁকে দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় এসে পড়লে আমরা নজরুলের প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত করব। কথা ছিল, আমাদের শিশুরা আর কখনোই ভূতের ভয় পাবে না। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়া সারল্যমাখা চোখগুলো মগ্ন হয়ে পাঠ করবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসের পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণের গল্প, গ্যালিলিওর যন্ত্রণা ও ব্রুনোর পুড়ে যাওয়ার হাহাকার। কথা ছিল, আমাদের কবিতার শব্দাবলিজুড়ে রক্তস্নাত স্বদেশ কাঁদবে। আমাদের গানের সুরে বীরাঙ্গনার কাতর চিৎকার গুমরে উঠবে, রংতুলির ক্যানভাসে ভেসে উঠবে বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা করোটির দুচোখভরা শূন্যতা। আজ যখন নিজের দিকে তাকাই, স্বদেশের মানচিত্রে তাকাই, নির্মম ব্যবচ্ছেদে মাতি, টের পাই আমরা কেউ কথা রাখিনি। আমাদের ইমারত বেড়েছে, আর মন হয়েছে সংকীর্ণ। পুঁজি বেড়েছে, মুনাফার লিপ্সা বেড়েছে, আর আমরা সহমর্মিতা বিসর্জন দিয়েছি। উপায়সর্বস্বরা দানবের মতো উপায়হীনদের গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়েছি। অগ্রগতি ও উন্নয়নের দুরন্ত রথ ছুটছে। রথের চাকার ঘূর্ণিতে গড়ে ওঠা ধূলিচক্র ধাঁধিয়ে দিচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, পথপাশে দাঁড়ানো অথবা থমকে থাকা বঞ্চিত, হতবিহ্বল মুখগুলো ঝাপসা এখন। অশীতিপর বৃদ্ধ ভিক্ষুক শহরবানুর স্বামী যে সংগ্রামের বছর মরে গেছেন, সেই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এই মনুষ্যত্বহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হয়েছিল কি?
কাকে দোষারোপ করব আমরা? নিয়তি? যারা নিয়তি বা কপালের লিখন বিশ্বাস করি না, তারা উপলব্ধি করি এসব অসংগতি কিংবা প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি না মেলাটা পরিষ্কারভাবেই অব্যবস্থা অথবা সচেতনভাবে টিকিয়ে রাখা একটি ব্যবস্থার ফলাফল। একটি কথা আজকাল খুব শুনতে পাই যে এখন দেশে উন্নয়ন চলছে। এই উন্নয়ন–প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শক্তিকে কোনোভাবেই প্রশ্ন করা যাবে না, মগ্নতায় বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। এতে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবু। মানলাম। কিন্তু আমৃত্যু মানবেতর জীবনযাপনের উপযোগী অবিশ্বাস্য নিম্নমজুরি পেয়ে আসা চা-বাগানের শ্রমিকদের গলায় পা দিয়ে দাঁড়ানো দেশ উন্নয়নের কোন নজির স্থাপন করছে? হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকার চান্দপুর চা-বাগানের পতিত ভূমিতে সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এবং এরই ধারাবাহিকতায় চা-বাগানের অধীনে থাকা ৫১১ একর ভূমির ইজারা বাতিল করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চা-বাগানের শ্রমিকেরা দাবি করছেন যে এটি তাঁদের গ্রাসাচ্ছাদনের জায়গা। এখানে তাঁরা চাষাবাদ করেন। প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন মানে কি গরিব মারা? ধরে নিলাম, ওরা ব্রাত্যজন। কিন্তু দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলনে যাচ্ছেন কেন বারবার? বেতনবৈষম্য, পদমর্যাদা ইত্যাদি দাবি তোলার পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উচ্চারণ সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক সম্প্রদায় এবং সামগ্রিক অর্থে আমাদের রুচি ও সংস্কৃতির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, উন্নয়নের আলোর ঝলকানি কি সে অন্ধকারকে আড়াল করতে পারছে? পারা সম্ভব?
অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। প্রলয়কাণ্ডে ধ্বংস হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেলস্টেশন, আওয়ামী লীগ কার্যালয়, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ১১ জানুয়ারি সেখানে মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটা সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়েছিল। সংঘর্ষ ব্যাপক হয়ে উঠলে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষে আহত মাসুদুর রহমান পরে মারা যান। (প্রথম আলো, ১৩ জানুয়ারি) জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা সহিংস তাণ্ডবে মেতে ওঠে, ধ্বংসযজ্ঞ চালায় রেলস্টেশনে। জেলা পরিষদ মার্কেটে, কালীবাড়ি মোড় এলাকা, পুরাতন জেল রোড এলাকার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সুরসাধকের অজস্র স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করে দেয়।
রেলস্টেশনের ক্ষতি, মার্কেটের ক্ষত—সব সারিয়ে তোলা যাবে। কিন্তু ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের ক্ষতি? ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় সংগীতের পুরোধা আলাউদ্দিন ১৯৩৬ সালে নৃত্যনট উদয়শংকরের সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণ যাত্রায় আরবভূমির বড় বড় দেশ আর শহর দেখেছিলেন। কী ছিল তাঁর উপলব্ধি? জীবনীকার আলপনা রায়ের লেখায়, ‘... দেখলেন, আরবভূমির বড় বড় দেশ আর শহর। জেরুজালেম, জাফা, একার, স্মার্না, মিসর। এই মুসলিম দেশগুলোতে গিয়ে অবাক হলেন তিনি।... এখানে মোল্লাদের দাড়ি নেই। কিন্তু তাঁরা কেমন সুন্দর সুরেলা উচ্চারণে কোরআন পড়েন। মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে বাইরের কাজ করেন। দেশে থাকতে মনে হতো ইসলামে সংগীতের কোনো স্থান নেই। আর এখানে দেখলেন, নাচ-গান-বাজনার রীতিমতো চর্চা আছে। আরবি গানের সাথে মধুর বাজনা শুনে চোখে জল এল আলাউদ্দিনের। হিন্দুস্তানি রাগ-রাগিণীর সঙ্গে কত মিল এদের সুরের।’.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন আলোকিত আকাশে উন্নীত হয়েছিলেন। আমরা আজ পশ্চাৎপদ অন্ধকার থেকে তাঁর স্মৃতি ধ্বংস করলাম। আমাদের হৃদয় আজ শকুন ও শিয়ালের খাদ্য।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]