সংকট সমাধানে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন

বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির
ফাইল ছবি

চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে দুটি অপরাধী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত আটজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটির তদন্ত প্রয়োজন, যাতে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করে শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। রোহিঙ্গারা এমনিতেই মিয়ানমারে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। একই সঙ্গে এখন তাদের এক দ্বীপে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে। রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা, তাদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ক্যাম্পে ঘটা সহিংসতাকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হতে পারে।

বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি জীর্ণশীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তিন বছর ধরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। সেখানে থাকতে হচ্ছে বর্ষার তীব্র বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড় আর গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ সহ্য করে। যেখানে নিজের ঘর হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো জায়গা নেই, উপার্জন করার মতো কাজ নেই, কোনোমতে এক বেলা খাবারের জোগান নেই, ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শিক্ষার সুযোগ নেই এবং এই পরিস্থিতির অবসান কবে হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

১৯৭৮ সালে প্রথম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখানে রোহিঙ্গারা যেমন আছে, তা কাঙ্ক্ষিত কিংবা টেকসই কোনোটাই নয়। গত মাসে জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আক্ষেপ করে বলেছেন, গত তিন বছরে কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা যায়নি। এ সমস্যা সমাধানে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ক্যাম্পে সেবা প্রদান, স্থানান্তর প্রক্রিয়া অথবা এর আগে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ইত্যাদি রোহিঙ্গাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের উদ্বেগের বিষয়গুলো যেমন উপেক্ষিত, তেমনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ ও মতপ্রকাশের অধিকারকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। গত মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘লেট আস স্পিক ফর আওয়ার রাইটস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ন্যায়বিচার, তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ে তাদের মতামত ও অনুভূতি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনের শিরোনামটি তরুণ এক রোহিঙ্গার বক্তব্য থেকে নেওয়া। নিজেদের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের কথা বলতে দেওয়া উচিত—বিশ্ববাসীর প্রতি তাদের এ বার্তাই শিরোনামটিতে ফুটে উঠেছে।

স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে এ কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভাষাগত জটিলতা, কিছু চিকিৎসাকর্মীর আচরণজনিত সমস্যা এবং বিদ্যমান চিকিৎসাসংক্রান্ত যথেষ্ট ধারণা না থাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়। এসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে খুব কমসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী কোভিড টেস্ট করাতে রাজি হয়। এ ছাড়া আইসোলেশনে পাঠানো এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করে।

মে মাসে বাংলাদেশ সরকার ৩০০–এর বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাসানচরে নিয়ে যায়। ভাসানচর বঙ্গোপসাগরে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ, যার বসবাসযোগ্যতার বিষয়ে জাতিসংঘের মূল্যায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। অভিযোগ আছে, শরণার্থীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়েই তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সেখানে তারা থাকতে চায় না। মানবাধিকার সংস্থা এবং নিজেদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগে ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গারা এ আরজি ব্যক্ত করেছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। শরণার্থীদের যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও আটকে রাখা হয়, তবে তা জাতিসংঘের নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার আইনের ধারা ৯ অনুযায়ী ‘আরবিট্রারি ডিটেনশন’-এ রাখার শামিল। এমনকি রোহিঙ্গাদের ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগও নথিভুক্ত করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

টেকনাফ-কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বের হতে না পারে, সে জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া শুরু করেছে। এ ধরনের বন্দিদশা স্থানীয় গোষ্ঠী এবং শরণার্থী উভয় পক্ষের ওপর বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিকতার মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুষ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং শরণার্থীদের মধ্যে হতাশা এবং একঘরে হয়ে পড়ার অনুভূতি তৈরি হওয়া।

স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’–এর তথ্যমতে, গত তিন বছরে মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযানে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে, এমন পাঁচজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। নিহত পাঁচজনের তিনজনকেই তাদের ঘর থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অধিকাংশ জানেই না কোথায় কীভাবে বিচার পাওয়া যাবে। আবার কেউ কেউ বিচার চাওয়ায় খারাপ পরিণতিরও ভয় পান।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ধরনের স্থায়ী সমাধানের আবেদন জানিয়েছেন, তা শরণার্থীদের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে অর্জিত হওয়ার নয়। মিয়ানমারে নিপীড়ন এবং একের পর এক সহিংস হামলার ফলে ১৯৭৮ সালের পর থেকে যতসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তার চেয়ে অনেক কমসংখ্যক ফিরে গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে এবং তাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শরণার্থী গোষ্ঠীর ভেতর থেকে শক্তিশালী নেতৃত্ব উঠে আসা প্রয়োজন। এতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাজ অনেকটাই সহজ হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অর্থবহ অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সে বিষয়ে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং অধিকার-সমুন্নত একটি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশি নীতিনির্ধারকেরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্থানীয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘায়িত এ শরণার্থী পরিস্থিতির একটি টেকসই সমাধান বের করতে পারবে।

সাদ হাম্মাদি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ক্যাম্পেইনার।

twitter:@saadhammadi