সমতার জন্য নারীর যাত্রা আর কত দিন

প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৮৫৭ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকেরা দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, শিশুশ্রম, মজুরিবৈষম্য ইত্যাদির প্রতিবাদে এবং ন্যায্য ও সমমজুরি, শ্রমঘণ্টা আট ঘণ্টা নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। সেদিন মালিকপক্ষ অমানবিক নির্যাতন চালিয়েও তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুখতে পারেনি। পরবর্তীকালে ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক নারীনেত্রী ক্লারা জেৎকিন এই দিনটিকে সারা বিশ্বে ‘নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। ১৯১১ সালের ৮ মার্চ প্রথম দিবসটি পালিত হয় অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষের সমতা, সম-অংশীদারত্ব ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে থাকে। এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বাংলা প্রতিপাদ্য ’টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। প্রতিপাদ্যটিতে নারীর সম–অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের আড়ালে এক গভীর হতাশার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ, ‘আজ’ যা অগ্রগণ্য, তা অনেক আগেই অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল।

শত ‘না’–এর বেড়াজালে আজও বন্দী নারীর জীবন। পদে পদে সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক নানা বিধিনিষেধ নারীর জীবনজুড়ে। এত ‘না’–এর ভার নিয়ে সমতার পথে এগোনো যায় কি! ভাবতে অবাক লাগে সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে শুরু করেছেন আমাদের নারীরা। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও থেমে নেই তাদের বিজয়যাত্রা। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ‘বৈশ্বিক জেন্ডারবৈষম্য প্রতিবেদন’ অনুযায়ী বিশ্বের ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম। নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ, শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতি ইত্যাদির কথা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলেদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল মেয়েরা, যা উন্নয়নশীল বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১০০ হাজার জনে ১৭৬ জন, যেখানে উন্নয়নশীল দেশে তা ২৩২। বর্তমানে ৬২ শতাংশ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের পন্থা অবলম্বন করেন; যা উন্নয়নশীল দেশে মাত্র ৫৩ শতাংশ।

এই বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্যটিতে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জেন্ডার সমতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ উন্নয়নকে স্থায়ী করতে হলে জেন্ডার সমতার কোনো বিকল্প নেই। তাই এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সমতার যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন আইন কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নতুবা সমতা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অধরাই রয়ে যাবে।

তবে অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয় হলেও দেশে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র যেন এ ধরনের অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, প্রতিদিন পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী নির্যাতনের নতুন ধরন ও মাত্রা। সরকারি হিসেবেই বাংলাদেশের ৭২.৬ শতাংশ নারী তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতনের মধ্যে আছে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন। গত মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানে দেখা গেছে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। কোভিড প্রেক্ষাপটে সারা দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২০ সালে মোট ১৬২৭ জন নারী ও ১০১৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ব্র্যাকের জরিপে ৯৬ শতাংশ নারীর গণপরিবহনে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য আমাদের জানিয়ে দেয় কোথাও নিরাপদ নয় নারী। প্রথম আলো ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপে দেখা গেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৫৩ শতাংশই এ দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এবং সানেম যৌথভাবে ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রকল্পভুক্ত এলাকায় ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে, যেখানে দেখা গেছে যে ৩৪.২৬ শতাংশ নারী শারীরিক এবং ২৯ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ নারীই পুরুষ কর্তৃক কোনো না কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। দেশের নারী নির্যাতনের এই সব ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের দেশের নারী অগ্রযাত্রায় এক অশনিসংকেত।

আরও পড়ুন

নারীর নিরাপত্তাবিধানে ও অধিকার রক্ষায় রয়েছে বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন; যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭, বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা ২০১৮, বাল্যবিবাহ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন ২০১৮-২০৩০। তবে নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা; যেমন মামলার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, তথ্য–প্রমাণের অভাব, সহিংসতার শিকার নারীদের নানা ধরনের আপত্তিকর জেরার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা দূর করে মামলাগুলোর যথাযথ তদন্ত ও প্রসিকিউশন–ব্যবস্থা ত্বরান্বিত জরুরি। এ ছাড়া জেন্ডার সমতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে নীতিনির্ধারকদের আইনগত, সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ছোটবেলা থেকেই ছেলেশিশুদের ইতিবাচক পুরুষের আচরণের ধারণা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ ছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষ ও কিশোরদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। কমিউনিটিতে ইতিবাচক পুরুষের ‘রোল মডেল’ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি, যাকে বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা অনুসরণ করবে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীর নিরাপত্তা ও জীবনমানের স্থায়ী উন্নয়ন ব্যতিরেকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে গেলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। নারীর জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে নারীর সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটবে না। ফলে বিঘ্নিত হবে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন। এই বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্যটিতে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জেন্ডার সমতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ উন্নয়নকে স্থায়ী করতে হলে জেন্ডার সমতার কোনো বিকল্প নেই। তাই এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সমতার যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন আইন কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নতুবা সমতা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অধরাই রয়ে যাবে।

নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী