আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃজন করেছেন। সেই মহান স্রষ্টাকে জানতে, বুঝতে এবং খাঁটি মুসলমান হওয়ার জন্য শিক্ষার্জনের বিকল্প নেই। মানবজীবনে অক্ষরজ্ঞানহীন অবস্থাই হলো নিরক্ষরতা। কোনো বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা বা জ্ঞানার্জন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষার পূর্বশর্ত হলো অক্ষরজ্ঞান। তাই নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞানসমৃদ্ধ করার জন্য ইসলামে জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পড়ো! তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১)মানব-ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে শিক্ষার একটি কল্যাণময় দিক রয়েছে। বিদ্যাশিক্ষার উত্পত্তি পৃথিবীর আদিমানব সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.), যিনি মানবজাতির শিক্ষাগুরু। তিনি যে উত্স থেকে জ্ঞান লাভ করেন তা হচ্ছে ওহি বা ঐশীবাণী। পরিশেষে প্রাক-ইসলামি যুগের অমানিশার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে জন্ম নিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদর্শ মহাপুরুষ মানবজাতির মহান শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর কাছে যে ওহি আসত তা থেকে মানুষের জন্য যা শিক্ষণীয়, ইসলামের অনুসারীকে তা শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ, শিক্ষা-কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান প্রমাণ করে যে, তিনি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-গবেষক এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাঁর গৃহীত নীতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাদর্শন। পবিত্র কোরআন ও হাদিস থেকে শিক্ষার যে গুরুত্ব বা তাগাদা তার মর্যাদা অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘বিদ্যাচর্চা বা শিক্ষার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য।’ (ইবনে মাজা)ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে (৬২৪ খ্রি.) প্রতিপক্ষের নেতৃস্থানীয় ৭০ জন লোক নিহত ও ৭০ জন লোক মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। ইসলামের ইতিহাসে বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে যারা মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ হয়, তাদের মদিনার মানুষকে লেখাপড়া শিখিয়ে দেওয়ার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। সেদিন তাদের কাছ থেকে রক্তের বদলা না দিয়ে বরং মুক্তিপণ হিসেবে ১০ জন নিরক্ষরকে অক্ষরজ্ঞান দান করা নির্ধারণ করে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের মুক্তি নিশ্চিত করা হয়। নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে জীবনের চরম শত্রুকে নবী করিম (সা.) শিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে মদিনায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করলেন। পবিত্র কোরআনের বাণীকে জাতির সামনে তুলে ধরে নিরক্ষরতার মূলে আঘাত হেনে শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টি হূদয়গ্রাহী করে তুললেন। আল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করে তিনি মানুষকে সুসংবাদ জানালেন, ‘যাকে জ্ঞান-প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করা হয়েছে তাকে মহাকল্যাণে ভূষিত করা হয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬৯) নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষার্জনের অনুপ্রেরণার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.) কিছু বাস্তবমুখী ফলপ্রসূ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সাফা পর্বতের পাদদেশে ‘দারুল আরকাম’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাকার্যক্রম তিনি নিজেই সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এটিই ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম শিক্ষালয়। এভাবে মদিনায় হজরত আবু উসামা বিন যুবায়ের (রা.) বাড়িতে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হজরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)কে নবী করিম (সা.) এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত এটিই সর্বপ্রথম শিক্ষালয়। আর দ্বিতীয় শিক্ষালয়টি হচ্ছে হজরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর ব্যক্তিগত বাসভবন যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ আট মাস শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষার আলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে রাসূলে করিম (সা.) এভাবে আলোকিত মানুষকে নিয়ে সুশীল সমাজ গড়ার দৃপ্ত শপথ নেন।নিরক্ষর ও শিক্ষাবঞ্চিত লোকদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নবী করিম (সা.) মসজিদভিত্তিক বিশেষ শিক্ষাগারে আবাসিক শিক্ষাকার্যক্রম হাতে নেন। সাহল ও সুহাইল নামের দুই সহোদর সাহাবির কাছ থেকে ক্রয়কৃত জমিতে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত মসজিদভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ‘আসহাবে সুফ্ফা’ বলা হতো। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত সাইয়েদ ইবনুল আস (রা.) এ প্রতিষ্ঠানের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। হিজরি দ্বিতীয় সালে নবীজি ‘দারুল কোবরা’ নামে আরও একটি আবাসিক প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রেখে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন তৈরিতে অশেষ অবদান রাখেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান রাখে আর যে জ্ঞান রাখে না তারা উভয় কি সমান হতে পারে?’ (সূরা আল-যুমার, আয়াত: ৯)আরবে লেখাপড়ার প্রচলন খুব অল্পই ছিল। কিন্তু যখন ইসলামের আগমন ঘটল, তখন যেন লিখনপদ্ধতিও নিয়ে এল। আল-কোরআন লিপিবদ্ধ ও সুসংহত করার প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) লিখনপদ্ধতি প্রচলনের প্রতি মনোযোগ দিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহ যাকে কল্যাণ করতে চান, তিনি তাকে দীনের সঠিক জ্ঞান দান করেন। আর অবশ্যই আমি (জ্ঞান) বণ্টনকারী এবং আল্লাহই তা দান করেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষকসুলভ আচরণের মাধ্যমে আরবদের মধ্যে লুকায়িত সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার কর্মসূচিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান অন্বেষণে যুক্ত হতে মানুষকে এত বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন যে তাঁর বাণী শিক্ষাদর্শনের কালোত্তীর্ণ উপমারূপে গণ্য হয়েছে। ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। dr.munimkhan@yahoo.com