সরকার আর কত দিন উদাসীন থাকবে

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি বলা যায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে। করোনাকালে অর্থনীতি চালিয়ে নিতে রেমিট্যান্সই হয়ে ওঠে আমাদের প্রধানতম ভরসা। অথচ সেই প্রবাসীদের প্রতি বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা ও দুর্ব্যবহার নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট ও ভিসা জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে ভোগান্তি নতুন কিছু নয়। সেখানে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। গত এক দশকে প্রায় ৪০ হাজার প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়তে থাকলেও তা প্রতিরোধে সরকার সক্রিয় নয়, মৃত্যুর ঘটনা তদন্তেও উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো। প্রবাসী কর্মীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও নেই কোনো নজরদারি।

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) এক প্রতিবেদনে প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে এমন দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। উপসাগরীয় দেশগুলোতেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের। বিদেশের মাটিতেও অনেক প্রবাসীর দাফন হচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনো অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়। মৃত্যুসনদে গণহারে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধে মৃত্যু’ লিখে দেওয়ায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। প্রতিবেদনটি প্রকাশের অনুষ্ঠানে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের’ প্রতি রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা পালনে প্রায় ব্যর্থ হয়েছেও বলে স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ তানভীর শাকিল। সেখানে অভিবাসনবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্যসচিব মাহজাবিন খালেদ বলেন, ‘আমরা প্রবাসী আয় নিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি, এর পেছনের তিক্ত গল্প নিয়ে ততটা কথা বলি না। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে প্রবাসী কর্মীবান্ধব করার পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।’

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই নির্মাণ, গৃহকাজ ও সেবা খাতের মতো নিম্ন মজুরি খাতে কাজ করেন। বিদেশের অগ্রগতিতে তাঁরা অবদান রাখছেন, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকেও সচল রাখছেন। কিন্তু সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলায় বিদেশের মাটিতেই মরতে হচ্ছে তাঁদের। অনেক সময় ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, অতিরিক্ত কাজের চাপ, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, উচ্চ ক্যালরির খাবারের প্রবণতা প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর চাপ তৈরি করছে। কর্মীদের মৃত্যুর কারণ সরকারিভাবে যাচাই করা এবং তা প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রবাসীদের সেবায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো আমাদের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। প্রবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতায়ও তাঁরা এগিয়ে। প্রবাসী কর্মীদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ও নিয়মিত যোগাযোগের কোনো বিকল্প নেই।

মৃত্যুর পর প্রবাসীর লাশ দেশে আনতেও চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সরকারের কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় স্বজনদের। এ নিয়ে প্রবাসীরা প্রথম আলোর কাছে চিঠিও পাঠান। যেখানে সরকারের প্রতি তাঁদের আকুল আবেদন থাকে—প্রবাসীদের একটিই চাওয়া, বিদেশের মাটিতে মৃত্যু হলে তাঁদের মৃতদেহ যেন হাসপাতালের মর্গে মাসের পর মাস পড়ে না থাকে। মৃতদেহ দেশে পাঠাতে যেন পরিবারের ভিটেমাটি বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা জোগাড় করতে না হয়। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, ‘পুরো অভিবাসন খাত দুর্নীতিগ্রস্ত। এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে গেলে অনেকের পকেটেই হাত পড়বে। এ খাতে ব্যবসা চলতে থাকবে। কিছু মানুষ ফুলেফেঁপে বড়লোক হবে আর গরিব মানুষের দুর্ভোগ চলতে থাকবে।’ এর মাধ্যমে কি অভিবাসন খাত নিয়ে সরকারের ব্যর্থতাই প্রকাশ পাচ্ছে না?

যঁাদের রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, তঁাদের এমন করুণ দশা আমরা আর দেখতে চাই না। প্রবাসীদের প্রতি সরকারের উদাসীনতার অবসান হোক।