জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসাশিক্ষা নয়

দেশের ১১০টি মেডিকেল কলেজের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ আমলে প্রতিষ্ঠিত—এটি গৌরবের সমাচার না হয়ে শিক্ষার্থীদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মেডিকেল কলেজ চালু রাখতে যে ন্যূনতম অবকাঠামো, যোগ্য লোকবল ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা দরকার, তার কিছুই এসব প্রতিষ্ঠানে নেই।  

প্রথম আলো সম্প্রতি দুটি সরেজমিন প্রতিবেদন করেছে যথাক্রমে ‘১১ কক্ষেও মেডিকেল কলেজ’ ও ‘৬ মেডিকেলে জোড়াতালির শিক্ষা’ শিরোনামে। দুটি প্রতিবেদনে যে ১২টি সরকারি মেডিকেল কলেজের চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়। এসব মেডিকেল কলেজের নিজস্ব ভবন নেই, চলছে ভাড়াবাড়িতে। অন্যদিকে অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই, কোনো কোনো কলেজে একজন মাত্র অধ্যাপক, যিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। 

মেডিকেল শিক্ষা হলো হাতে–কলমের। কিন্তু হাতে–কলমে শিক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, তার প্রচণ্ড ঘাটতি আছে উল্লিখিত সব মেডিকেল কলেজে। সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চাঁদপুর মেডিকেল কলেজটি চলছে ১১টি কক্ষ নিয়ে। কোনো কোনোটির অবস্থা আরও শোচনীয়।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, ‘কিছু মেডিকেল কলেজ চলার মতো না। আমার ধারণা, ৫০ শতাংশ সরকারি মেডিকেল কলেজ ঠিকমতো চলছে না। সব কটিকে চালু রাখার মানে হয় না। কিছু একটা করতেই হবে। কী করা যায়, তা নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর সক্রিয়ভাবে চিন্তাভাবনা করছে।’

 বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিজের জায়গায় নিজস্ব ভবনে মেডিকেল কলেজ, কলেজের আয়তন, শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি—এ রকম আরও অনেক বিষয়ে শর্ত আরোপ করা হয়। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এসব শর্ত পূরণ করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হয়; যদিও সেখানেও অনেকে ফাঁকি দিয়ে থাকেন। সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, সেটা সরকারি কলেজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? 

সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে না পারলে অর্ধশিক্ষিত চিকিৎসক তৈরি হবে। এতে আর যা–ই হোক, মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা পাবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে যেমন উচ্চশিক্ষার সর্বনাশ করেছে, তেমনি ন্যূনতম সুযোগ–সুবিধা ছাড়া একের পর এক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মেডিকেল শিক্ষারও বারোটা বাজিয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের তিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যথাক্রমে আ ফ ম রুহুল হক, মোহাম্মদ নাসিম ও জাহিদ মালেক প্রতিযোগিতা করে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য জনবল কৌশলপত্র ২০২৪’–এ বলা হয়, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩৪ শতাংশ অধ্যাপকের পদ এবং ৪৬ শতাংশ সহযোগী অধ্যাপকের পদ খালি। আর সব ধরনের শিক্ষকের ৪৪ শতাংশ পদ খালি। 

কলেজগুলোতে এত পদ খালি রেখে মানসম্পন্ন চিকিৎসাশিক্ষা চলতে পারে না। ক্ষমতাসীনদের মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার যতই খায়েশ থাকুক না কেন, তারা শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে না। অবিলম্বে এসব কলেজের অবকাঠামো তৈরি, লোকবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করে শিক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যথায় এগুলো একীভূত করতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রমের মাঝপথে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। 

কথা হচ্ছে চিকিৎসাবিদ্যার মতো শিক্ষা কার্যক্রম তো জোড়াতালি দিয়ে চলতে পারে না। সরকারকে দ্রুত বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যঁারা আইন লঙ্ঘন করে এসব মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তঁাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।