বাল্যবিবাহ রোধে প্রয়োজন সর্বাত্মক পদক্ষেপ

সম্পাদকীয়

সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ এক–তৃতীয়াংশ কমানোর কথা থাকলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। বরং কোভিডের সময় বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যায়।

ইউএনএফপিএর ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, এশিয়ায় এটিই সর্বোচ্চ। তাহলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করেছে বলে নীতিনির্ধারকেরা জোর আওয়াজ তোলেন, সেটা কি ফাঁপা বুলি?

বাল্যবিবাহ বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকিও যে বেড়ে যায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে মা হলে তাঁদের বলা হয় কিশোরী মা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাতে শুক্রবার প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭০ কিশোরী মা হচ্ছেন। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, এই হার ২০১৮ সালে ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ। অনেকে এটাকে করোনার প্রভাব বলে মনে করেন। করোনার সময় বিদ্যালয়ে মেয়েশিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার হঠাৎ করে বেড়ে যায়।

কিশোরী বয়সে মা হলে মা ও সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যাবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ বছর বয়সের আগে একটি মেয়ের শরীর বিয়ে ও গর্ভধারণের জন্য তৈরি হয় না। এই বয়সে গর্ভে সন্তান ধারণের মানে হলো ‘শিশুর গর্ভে শিশু’। ডব্লিউএইচওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কিশোরী মাতৃত্ব অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।   ৬০ শতাংশ কিশোরী মা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। তাঁদের পুষ্টির অভাব থাকে। অপুষ্ট মায়ের বাচ্চাও অপুষ্টির চক্রে ভোগে। কিশোরী অবস্থায় গর্ভবতী হলে গর্ভপাত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে।

এ কারণে সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২১ সালের বাল্যবিবাহ এক–তৃতীয়াংশ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। সরকার একদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ শূন্যে নিয়ে আসার কথা বলছে, অন্যদিকে ২০১৭ সালে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ১৮ বছরের সীমা শিথিল করেছে। এটা যে পরস্পরবিরোধী সে কথা প্রথম আলো বহুবার বললেও নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেননি।

কিশোরী মা মানে মা ও সন্তান—উভয়কে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা। এর দায় কেবল মা ও সন্তান নয়, ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও বহন করতে হবে। অতএব বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। বরং আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। আশার কথা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে এবং সমাজে ইতিবাচক জনমতও তৈরি হচ্ছে।

বাল্যবিবাহ, কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের বিষয়টি শুধু সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে রোধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন। আমরাও স্বীকার করি, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মনোভাবটাও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহ নিরোধে নাগরিকদের সচেতন হওয়ার আগে সরকারকেও এই সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করতে হবে। শূন্য বাল্যবিবাহ ও শূন্য কিশোরী মাতৃত্বের লক্ষ্য নিয়েই সরকারকে কাজ করতে হবে।