উপাচার্যশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দেন, তাঁকে নিয়োগ দেন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এ পদ অপরিহার্য। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘একাডেমিক লিডার’ শুধু নন, তিনি প্রশাসনিক প্রধানও বটে। উপাচার্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে চলতে পারে না। কিন্তু এ মুহূর্ত বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। উপাচার্যের পরই যে গুরুত্বপূর্ণ পদটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন, সেই সহ-উপাচার্য ছাড়াই চলছে ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্ধশতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষও নেই। শীর্ষ তিনটি পদ ফাঁকা থাকায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিকসহ বিভিন্ন কাজে নানামুখী জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।

দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৬টি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৭টি। মোট ১৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩০টিতে উপাচার্য না থাকার বিষয়টি বিস্ময়কর এবং অগ্রহণযোগ্য। এগুলোর মধ্যে তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলোতে সময়মতো উপাচার্য নিয়োগ করতে না পারার দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কারণ, কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কখন উপাচার্যের পদ শূন্য হবে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগে থেকেই জানে। তাই শূন্য পদটিতে নিয়োগদানের প্রক্রিয়া আগেই শুরু করা উচিত। কিন্তু মন্ত্রণালয় তা শুরু করে শেষ মুহূর্তে, যখন উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। ফলে একজন উপাচার্য মেয়াদ শেষে বিদায় নেওয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই পদে নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে না; বিশ্ববিদ্যালয়টি উপাচার্যহীন হয়ে পড়ে।

২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ শূন্য রয়েছে—এ পরিস্থিতি কেন? এমন সমস্যা চলে আসছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর থেকেই। আইন অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের সাচিবিক কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠানো প্রস্তাব মন্ত্রণালয় নানা প্রক্রিয়া শেষ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। আইনানুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এ তিন পদে নিয়োগ দিতে একেকটি পদের বিপরীতে তিনজন অধ্যাপকের নাম পাঠায়। অনুমোদিত ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শীর্ষ পদে নিয়োগের জন্য ৩২১ জন অধ্যাপকের প্রয়োজন। কিন্তু এত যোগ্য অধ্যাপক পাওয়া কঠিন। আবার তিনটি নাম পাঠালেও বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নির্দিষ্ট একজনকে চায়, বাকি দুটি নাম ডামি হিসেবে পাঠায়। কিন্তু ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহ বুঝতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে দর–কষাকষি শুরু করে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এমন দুটি গুরুত্বহীন নাম পাঠায়, যাদের বিবেচনার সুযোগই না থাকে। এমন ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনো পুরো প্রস্তাব বাতিল করে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চাওয়া নামটির পক্ষে অবস্থান নেয়।

নিয়োগের এ প্র​ক্রিয়ায় অনেক সময় তিন-চার মাস পর্যন্ত লেগে যায়, তারপর একবার প্রস্তাব ফেরত গেলে আরও কয়েক মাস লাগে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির উচিত এ প্রক্রিয়া আরও সহজ করা। নিয়মানুগভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও পরিচালনাকারীদের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সময় অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রস্তাব পাঠায়, আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অজুহাতে বিষয়টি আটকে রাখে। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো অংশের দায়িত্ব পালনে অবহেলার পাশাপাশি অনৈতিকতার চর্চা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দ্রুতগতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের কাজটি সময়মতো সম্পন্ন করতে স্বাভাবিক ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া কেন থাকবে না, কেন বিলম্ব, সে জন্য দায় কার—এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ—সংশ্লিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেন আচার্য বা রাষ্ট্রপতি; রাষ্ট্র তাঁকে সেই ক্ষমতা ও মর্যাদা দিয়েছে।