খাদ্যনিরাপত্তা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে

>
এ এম এম শওকত আলী
এ এম এম শওকত আলী
এ এম এম শওকত আলী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। প্রাক্তন এই সিএসপি কর্মকর্তা ২০০১ সালে সচিব হিসেবে অবসরে যান। তিনি বহু গবেষণাগ্রন্থের রচয়িতা। খাদ্যনিরাপত্তা তাঁর গবেষণার মুখ্য বিষয়। সাম্প্রতিক বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন ত্রাণ পুনর্বাসন, দুর্যোগ মোকাবিলা ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো : এবারের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি কতটা ছিল?

এ এম এম শওকত আলী : বন্যার আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বন্যা আসবে, এটা তো আমরা জানি। আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে, তা–ও অজানা নয়। কিন্তু দেখার বিষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি কী ছিল। ২০০৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে একটি অ্যাকশন প্ল্যান বা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তখন দুর্যোগ মোকাবিলায় যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তা কোথায় ব্যয় হয়েছে, জনগণ কি সুফল পেয়েছে, সেটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো : এবারের বন্যার প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে গেল কেন?

এ এম এম শওকত আলী : প্রতিবছরই কমবেশি বন্যা হয়। এ বছর দেশের এক-তৃতীয়াংশ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ, যথা শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভারতে বন্যা হয়েছে। চীনে বন্যা হয়েছে। শ্রীলঙ্কা বাদে বাকি তিনটি দেশ বাংলাদেশের উজানে। সেখানে বেশি বৃষ্টি হলে তার প্রভাব এখানে পড়বে। নিকট অতীতের কোনো বন্যায় শহরে পানি ঢোকেনি। এবার শহরেও ঢুকেছে। ২৫টি পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। চুয়াত্তরের ভয়াবহ বন্যায় কিন্তু সিলেট, হবিগঞ্জের মতো শহরে পানি প্রবেশ করেনি। এখানেই সরকারের নীতি-পরিকল্পনার প্রশ্ন আসে। চুয়ান্নর বন্যার পর পাকিস্তান সরকার মার্কিন সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স দিয়ে একটি জরিপ করে বন্যা মোকাবিলায় কী করণীয়, সেটি ঠিক করেছিল। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলো বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই প্রকল্প তখন সুফল দিয়েছিল। এখন নতুন করে ভাবতে হবে।

বন্যা বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে। এরপর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপকূল এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র করা হলেও বন্যা মোকাবিলায় সে রকম কিছু নেই। এটি না হওয়ার অন্যতম কারণ বন্যাপ্রবণ এলাকায় উঁচু জায়গার অভাব। সেখানে বেশির ভাগই নিচু জমি। ফলে বন্যা এলে আমরা সতর্কবাণী দিয়ে দায়িত্ব শেষ করি।

প্রথম আলো : তাহলে কি আপনি বলতে চান, বন্যা মোকাবিলায় সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না?

এ এম এম শওকত আলী : মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হয়। কিন্তু বড় ধরনের পরিকল্পনা তো দেখি না। ১৯৮৮ সালে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছিল। সে জন্য ইনস্টিটিউশনাল স্টাডি বা প্রাতিষ্ঠানিক জরিপও করা হলো। ইউএসএআইডির সহায়তায় ইস্টার্ন ওয়াটার স্টাডি হলো। তারা বলল বন্যা হবেই, বন্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। অন্যদিকে ফরাসি বিশেষজ্ঞরা বললেন, আগাম প্রস্তুতি নিলে বন্যার ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। ওই সময় বন্যা মোকাবিলায় যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলো কতটা সুফল দিয়েছে, তারও মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।

প্রথম আলো : চলতি বছর খাদ্য মজুত সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছিল। সাম্প্রতিক বন্যা কি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মনে করেন?

এ এম এম শওকত আলী : ২০০৭-০৮ সালে আমাদের খাদ্য মজুত ধারণক্ষমতা ছিল সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন। গুদামে তখন কোনোমতে ১৪ লাখ টন মজুত করা যেত। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আরও গুদাম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমাদের সরকারি কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয় না। কিন্তু সেটি করলে কাজ আরও সহজ হতো। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ২৫ লাখ টন খাদ্য মজুত করা যায় এমন ব্যবস্থা করা। বর্তমানে ১৭ লাখ টন মজুত করার অবকাঠামো আছে। এ ছাড়া চাল মজুত করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির সাইলো নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রথম আলো : খাদ্যে স্বাবলম্বী দেশ হঠাৎ ঘাটতির দেশে পরিণত হওয়ার কারণ কী?

এ এম এম শওকত আলী : খাদ্য মজুতের দুটি ধরন—একটি বসতবাড়িতে মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মজুত করে, আরেকটি সরকার মজুত করে আপৎকালীন প্রয়োজন মেটাতে। প্রতিবছর ধান–চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেটি পূরণ হয় না। খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি বলেই ধারণা করি। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে দুটি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ খাদ্য উৎপাদন। আর খাদ্য মন্ত্রণালয় সেটি সংগ্রহ ও সরবরাহ করে থাকে। খাদ্য মজুত তিন লাখ টনের নিচে যাওয়াটা বিপজ্জনক, যা এবার গিয়েছে। কেননা আমদানি তো সময়সাপেক্ষ।  বিদেশ থেকে চাল কিনলেই হবে না, সেটি মানসম্পন্ন হতে হবে। আবার আমদানি করা চাল যাতে ভোক্তার কাছে স্বল্প সময়ে পৌঁছানো যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

প্রথম আলো : এবার ঘাটতির পরিমাণ কেমন হতে পারে?

এ এম এম শওকত আলী : প্রথমে অকালবন্যায় হাওরের ফসল নষ্ট হয়েছে। সেখানে বোরোর আবাদ বেশি হয়। আমন সামান্য। এরপর উত্তরাঞ্চলে বন্যায়ও অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। দুর্গত এলাকায় খাদ্য  সমস্যা দেখা দিতে পারে, যদি না ত্রাণসামগ্রী দুর্গত মানুষের কাছে সময়মতো পৌঁছানো যায়। তাঁদের নগদ টাকা দিলে লাভ নেই। অনেক জায়গায় চুলা জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। অতীতে দেখেছি, বেসরকারি সংস্থাগুলো ত্রাণকাজে এগিয়ে আসছে। এবার সে রকম কিছু দেখছি না। শুধু প্রধানমন্ত্রী বিত্তবানদের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এর সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো : এবারের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব হয়েছে কি?

এ এম এম শওকত আলী : যথাযথ হিসাব এখনো হয়নি। দেশে ফসলি জমির পরিমাণ ২৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪৮ হেক্টর। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৫ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৩ হেক্টর। তবে মনে রাখতে হবে, খেত পানিতে ডুবলেই শস্য নষ্ট হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৪ দিনের বেশি পানি থাকলে শস্য নষ্ট হয়। সে ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ১৭ লাখ টন। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তার দিক দিয়ে আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছি। আমদানির জন্য এ পর্যন্ত কী পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছে, খাদ্য আসতে কত দিন লাগবে, এসবও বিবেচনায় নিতে হবে। এর সঙ্গে আগামী ফসলের কথা ভাবতে হবে। বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। আমি যতটা জানি, কৃষি মন্ত্রণালয় মূল্যায়ন কাজ শুরু করছে। তাদের কর্মীরা মাঠে গিয়ে জরিপ করছেন।

প্রথম আলো : কৃষি পুনর্বাসনের কাজ কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যাবে?

এ এম এম শওকত আলী : বন্যার পর প্রতিবছরই পুনর্বাসনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, সরকারি খরচে কৃষকদের সার ও বীজ দেওয়া হবে। এটি কৃষি পুনর্বাসনের মূল কাজ। উৎপাদনের খরচ সরকার বহন করবে। কিন্তু মজুরির দায়িত্ব নিতে হবে কৃষককেই। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকিতে পাওয়ার টিলার দেওয়া হচ্ছে। তাদের তেলের খরচ দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। আমাদের দেশে ত্রাণের তালিকা নিয়ে কিছু অনিয়ম ও ত্রুটি থাকেই। প্রতিকারের উপায় হলো মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা। কৃষি পুনর্বাসনে শুধু বোরোর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। রবিশস্য ও শাকসবজি উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় তো উৎপাদন করছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সেটি ঠিকমতো সরবরাহ করা। বন্যা–পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি সফল করতে হবে।

প্রথম আলো : খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকায় চাল দেওয়া কর্মসূচিকে কীভাবে দেখছেন?

এ এম এম শওকত আলী : এটি আমি কখনো সমর্থন করিনি। মানুষও চায়নি। কেউ তো বলেনি, মানুষ না খেয়ে আছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে দেখেছি এ কর্মসূচি নিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তাবেষ্টনী নামে সরকারের যে কর্মসূচি আছে, সেটি প্রান্তিক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট।

প্রথম আলো : দুর্গত মানুষকে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রয়োজনীয় ক্যালরি থাকছে কি না?

এ এম এম শওকত আলী : বসতবাড়িতে কেউ ক্যালরি মেপে খায় না। শহর এলাকায় ক্যালরির হিসাব করা হয়। সেখানে অনেকের খাদ্য তালিকায় মাছ–মাংস থাকে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ মানুষেরই সেই সুযোগ নেই। ভূমিহীন ও গরিব মানুষই বেশি অপুষ্টিতে ভোগে। এ কারণে বন্যার পর সেখানে পুষ্টিঝুঁকি দেখা দিতে পারে, যাকে বলে হিডেন হাঙ্গার। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি জোরদার রাখতে হবে। তালিকা যাতে পক্ষপাতমূলক না হয়, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি ঠিকমতো না চললে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যাও বাড়বে।

প্রথম আলো : খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটি (এফপিএমইউ) তো পরিস্থিতি জানত। তাহলে মজুত এত কমল কীভাবে?

এ এম এম শওকত আলী : এদের ভূমিকা মূল্যায়ন করা উচিত। যখন প্রথম ধাক্কা এল, মজুত তিন লাখ টনের নিচে নেমে গেল, তখনই খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বলা উচিত ছিল। তারা যদি তা বাস্তবায়ন না করে থাকে, জবাবদিহি করতে হবে।

বন্যার পর মূল কাজ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু ত্রাণ মন্ত্রণালয় কাজ ঠিকমতো করতে পারবে না, যদি স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের সহায়তা না করেন। অতীতে আমরা উপজেলা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতাম। ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় তালিকা তৈরি করতেন। তালিকা ঠিকমতো হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে তদারক করতেন। এই তদারকি থাকা দরকার। বন্যায় রাস্তাঘাটের যে ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এ এম এম শওকত আলী : আপনাকেও ধন্যবাদ।