আসুন, ঈদের আনন্দে সম্পর্কগুলো ঝালাই করে নিই

ছবি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মানুষের মন কখন, কী কারণে, কোন কথার পরিপ্রেক্ষিতে খারাপ হয়; তার জন্য অনেকটাই উদ্ভূত পরিস্থিতি দায়ী। কেউ ইচ্ছে করে মন খারাপ বা মনোমালিন্য হোক, চায় না। তবে তা মানবজীবনে অহরহ ঘটতে থাকে। কখনো আর্থিক, কখনো ঠুনকো আক্রোশ, কখনো বা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অহেতুক টানাহেঁচড়া আমাদের সম্পর্ক একটি বিরাট অন্ধকার খাদে ফেলে দেয়। কিছু মানুষ অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্তে নিজে ও অন্যকে প্রভাবিত করে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে চরম ভুল বোঝাবুঝির কারণে। ব্যক্তি যদি লোভে কাতর হয়ে অন্যের ওপর হামলে পড়ে, এতে কার কতটা দোষ বিচারবিশ্লেষণ করতে হবে। একতরফা শুধু একজনকে দোষী ভাবলে অন্যায় করা হবে তাঁর প্রতি। আমাদের বুঝতে হবে, চোখের দেখা বা ঠাট্টার ছলে বলা কথাগুলো কতটা সত্যি বা বাস্তবে কার্যকর।

মানুষের নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা বা নিজের ক্ষুদ্র জীবন উপভোগ করার বদলে অন্যের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় নষ্ট করার প্রবণতা খুব বেশি। এসব করার মধ্য দিয়ে নিজেরই ক্ষতি, এমনকি একটি সুন্দর গোছানো পরিবারও ধ্বংস হয়ে যায়, দিশাহীন হয়ে পড়ে। পরিবার কাকে রেখে কার পক্ষ নেবে, ভেবে দিশাহারা হয়। তার ফলস্বরূপ কেউ কারও মুখ পর্যন্ত দেখে না, বিপদ–আপদে কেউ কারও পাশে দাঁড়ায় না। তাহলে ক্ষতি কার হলো? নিশ্চয়ই ভুক্তভোগী পরিবার–পরিজনের। বাইরের লোক তখন মজা মারে, লে হালুয়া! অশান্তি জমে ক্ষীর! কিছু বদ মানুষের কাজ হলো বাইরে থেকে হুল ফুটানো।

পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কিংবা মনীষীদের বাণীতে তা আরও স্পষ্ট ফুটে ওঠে। পবিত্র কোরআনে আছে, ‘হে মুমিনগণ, অধিক অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান গোনাহ। তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে লেগে পড়ো না এবং একে অন্যের গিবত করো না।...তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত-১২)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক কোনো মুসলিমের দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখবেন।’ (সহিহ মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনো লোক অনুমতি ছাড়া তোমার দিকে উঁকি দেয়, আর তুমি তার দিকে কঙ্কর ছুড়ে মারো।’ (সহিহ বুখারি)।

কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নাক গলানো শিষ্টাচারবহির্ভূত। কেন আপনি অন্যের ফেসবুকে ঢুঁ মারবেন? কেন চ্যাট চেক করবেন? কেন অন্যের মোবাইল চুপিসারে কৌশলে নিয়ে তার ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট দেখবেন? কে দিয়েছে আপনাকে এই অনুমতি? এ তো গর্হিত কাজ। এখন এসবই চলছে সমাজে হামেশা। ঠুনকো কথার জেরে খুনখারাবি ঘটছে চোখের সামনে। মানসিক ডিপ্রেশনে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে মানুষ। এসব হচ্ছে শুধুই পারিবারিক কলহ, সন্দেহ আর মানমর্যাদা না পাওয়ার অনুশোচনায়।

পারিবারিক ও সামাজিক মেলবন্ধনের নতুন সুযোগ এনে দেয় পবিত্র ঈদ উৎসব। সবাই খুব আনন্দে মেতে ওঠে এদিন। সম্পর্কগুলো জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা, দীর্ঘদিন অদেখা থেকে মুক্তি পায় এবং নতুন আশার আলো দেখায় পরস্পর কাছে এলে। মুঠোফোনে যত কথাই হোক, বাস্তবে মানুষ চায় আন্তরিক উপস্থিতিতে প্রিয়জনদের হাতের পবিত্র ছোঁয়া, কোলাকুলি। এসব হলে সম্পর্কের উন্নতি হয় দ্রুত।

পরিবারে অনেকেই কর্মস্থল কিংবা ব্যক্তিগত কারণে সারা বছর পরিবার থেকে দূরে থাকে। কিন্তু এই ঈদ ঘিরে থাকে সবার মনে একধরনের ব্যঞ্জনা ও ব্যাকুলতা প্রিয় পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার। এই সময়ে সবার প্রতি আহ্বান, একে অন্যের দোষত্রুটি ক্ষমা করে, মনোমালিন্য ভুলে আপনজনদের বুকে টেনে নিন। একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে আহার করুন। ভালো–মন্দ, জীবনযাপন, চাকরি—সবকিছুর আন্তরিকভাবে খবর নিন। পরিবারের সমস্যাগুলো সহজভাবে তুলে ধরুন। ছোট–বড় সবার মতামত নিন। সবার মুখে হাসির ঝিলিক দেখতে পাবেন। মনে যে কত প্রশান্তি পাবেন, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। হাতে সময় থাকলে পালা করে কাছে বা দূরের আত্মীয়কে দেখতে যান। বছরে এই একটা দিন সবাই অধীর অপেক্ষা করে বসে থাকেন প্রিয়জনের মুখ একনজর দেখার জন্য। এতে ধনী–দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নেই।

মানুষই সর্বাগ্রে অগ্রগণ্য হয়। মানুষের ছোট্ট পরিসরের জীবনে সবাইকে নিয়ে হাসিখুশিতে সময় কাটান। একটা সময় যেন আফসোস না হয়—ইস, কেন নিজেকে একটু থামালাম না! কেন নিজেকে মানিয়ে নিলাম না! কেন অন্যের কথায় দোষী ভাবলাম, দূরে সরিয়ে দিলাম! পরিবারের বিষয়গুলো পরিবারেই কেন সমাধান করলাম না! তাই আসুন, আমরা ঈদে সবাই সবার কালো বদন নয়, বরং হাসির বদনে কাছাকাছি থাকি, প্রিয়জনের হাতের মজাদার খাবার মুখে তুলে নিয়ে কোলাকুলি করি, মনের শত কষ্ট ও মনোমালিন্য দূরে সরিয়ে দিই—হোক তা যত বড় অপরাধ। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করতে হবে পরিবারের সবাই একসঙ্গে মিলে।

আসুন, আমরা মিলেমিশে একে অন্যের সুখে–দুঃখের ভাগীদার হই। মনের জঠরের কষ্টগুলো উগরে দিই বিশাল সমুদ্রের পানিতে। প্রশান্ত করি নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে আত্মার বন্ধনে অটুট রাখি।

পারভীন আকতার
শিক্ষক
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম
[email protected]