ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেম: অবহেলা নয় সম্মানের দাবিদার

ব্রিটিশ উপনিবেশ শুধু আমাদের দাসত্বেই বন্দী করেনি, ধর্মীয় চেতনারও বড় ক্ষতি করেছিল। ইমানের দুর্ভেদ্য দুর্গে অনেক ফুটো করে দিতে পেরেছে তারা। প্রায় ৭৪ বছর পূর্বে আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও ধর্মীয় চেতনায় তাদের করা ছিদ্রগুলো এখনো মেরামত করার জন্য সচেতন হতে পারিনি। এটা কি আমাদের জন্য চরম লজ্জার বিষয় নয়?

মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদের জন্য প্রিয় ও পবিত্র স্থান। যাঁরা আল্লাহ তাআলার প্রিয়, তাঁরাই মসজিদ আবাদ করেন। মসজিদের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদিম। সেগুলো শুধু পেশা নয়, পবিত্র দায়িত্বও। এই দায়িত্ব সমাজের নেতৃস্থানীয় সব মুসলমানের। সমাজের প্রত্যেক মুসলমান হবেন মসজিদের খাদেম। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী হবেন মুয়াজ্জিন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হবেন ইমাম। পবিত্র কুরআনের সুরা তাওবার ১৮ আয়াতে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ (রক্ষণাবেক্ষণ) করবে, যারা ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারা হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’

দুই শ বছরের ইংরেজ শাসনে আমরা অর্থবিত্তে, চিন্তায় জ্ঞানে, ইমানে আমলে এক পঙ্গু জাতিতে পরিণত হয়েছি। দিন দিন এ পঙ্গুত্ব আরও বাড়ছে। অর্থবিত্তে একটু পরিবর্তন এলেও চিন্তার বৈকল্য কোনোভাবে কেটে উঠতে পারছি না আমরা। সমাজে ইমাম, মুয়াজ্জিন, মসজিদের খাদেম যেন সবচেয়ে নিম্নস্তরের। সমাজের সবার কাজ তাঁরা নিজেরা আঞ্জাম দিচ্ছেন। সবার পক্ষ থেকে তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন। সবার দায়িত্ব ছিল তাঁদের সম্মান মর্যাদা নিয়ে ভাবা। যাঁরা আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের পেরেশানি, আমাদের ব্যস্ততা, আমাদের জবাবদিহির দায়ও নিজেদের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। তাঁরা কীভাবে আমাদের কাছে অবহেলার পাত্র হতে পারেন, বড় আফসোসের বিষয়!

দেখা যাচ্ছে, শহরকেন্দ্রিক বড় মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম তিন পদেই লোক আছেন। অনেক মসজিদে খাদেম নেই। মুয়াজ্জিনই খাদেমের কাজে আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। গ্রামের বেশির ভাগ মসজিদে মুয়াজ্জিন, খাদেম নেই। ইমাম সাহেবই ইমামতির পাশাপাশি মুয়াজ্জিন ও খাদেমের কাজে আঞ্জাম দিয়ে যান।
আসুন একটু ভেবে দেখি, যিনি মসজিদের খাদেমের কাজ করেন, তাঁর কাজ কী? তাঁর কাজ মসজিদ পরিষ্কার রাখা, অজুখানা-বাথরুম পরিষ্কার রাখা ইত্যাদি। যাঁরা মসজিদে আসেন, তাঁরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর সামনে মাথা পেতে দিতে আসেন। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এই প্রিয় বান্দাদের মাথা পেতে দেওয়ার কাজ সুন্দরভাবে করার জন্য খাদেম সাহেব নিরলসভাবে কাজ করে যান। আল্লাহর কাছে সেজদা দেওয়ার জায়গাটি তিনি ঝাড় দিয়ে, ধুয়েমুছে পরিষ্কার রাখেন। একটু চিন্তা করে দেখুন, এই খাদেম সাহেব কত কত দামি কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু কি অর্থের বিনিয়মে এটি তিনি করেন, তাঁর অন্তর সব সময় মসজিদের সঙ্গে লেগে না থাকলে কি এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব?

দ্বিতীয়ত, মুয়াজ্জিন সাহেব যিনি আমাকে–আপনাকে প্রতিদিন পাঁচবার নামাজের জন্য ডাকেন। নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর শেখানো তরিকায় হৃদয়ের সম্পূর্ণ আবেগ, ভালোবাসা আর দরদ দিয়ে সুললিত কণ্ঠে মসজিদের দিকে আমাদের আহ্বান করেন। আমি কাজের ব্যস্ততায় আমার ওপর অবধারিত কাজ ভুলে যাই। তিনি ভুলে যান না। আমার দায়িত্ব পালন সহজ ও নিবিড় করে দেওয়ার জন্য পাঁচবার আমাকে ডেকে দিচ্ছেন। আমি শেষ রাতে আরামের ঘুমে ডুবে থাকি। মুয়াজ্জিন সাহেব মধুর কণ্ঠে আমাকে বলছেন, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম।’ জোহর থেকে ইশা পর্যন্ত মুয়াজ্জিন সাহেব ঘন ঘন আমাকে স্মরণ করেন। কারণ, এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আমোদপ্রমোদে মানুষ লিপ্ত হয়।

এরপর ইমাম সাহেব, যিনি নামাজে আমাদের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা জামাতের সঙ্গে নিয়ম মেনে তাঁকে অনুসরণ করে আল্লাহর কাছে সেজদায় নত হই। তাঁর তাকবিরে তাহরিমার সঙ্গে হাত ওঠাই, তাঁর ফাতেহার শেষে আমিন বলি, তাঁর রুকুতে রুকু যাই, তাঁর সঙ্গে সেজদা করি। তাঁকে আগবাড়িয়ে আমি কোনো কিছুই করি না, করতে পারি না। তিনি সালাম ফেরালেই তাঁর সঙ্গে সালাম ফিরিয়ে আমি নামাজ শেষ করি। ফলে তাঁকে আমরা কী করে অবহেলা করি। নামাজের বাইরে যদি তাঁকে সম্মান না করি, নামাজের ভেতরে তাঁর নেতৃত্বে কী করে আল্লাহর প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি হবে। যে মসজিদে মুয়াজ্জিন নেই, খাদেম নেই, সেখানে ইমাম সাহেবই সব দায়িত্ব পালন করছেন।

শুধু অর্থ দিয়ে কি ইমাম, মুয়াজ্জিনের হক আদায় করা সম্ভব? আসুন, তাঁদের সম্মান করি। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা দেখাই। তাঁদের অবহেলা, অবজ্ঞা, অসম্মান করলে নামাজের প্রতি মনঃসংযোগ আনাও সম্পূর্ণ হওয়ার কথা না। তাঁদের কোনো অপূর্ণতা বা দোষ-ত্রুটি থাকলে সেসব সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। সর্বোপরি, উপযুক্ত ও যোগ্য মানুষকে এসব দায়িত্বের জন্য আমরা নির্বাচন করি বা নিয়োগ দিই। তাতে এসব মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও হৃদ্যতাপূর্ণ ও গাঢ় হবে।

মুন্সি আব্দুল কাদির
সিনিয়র অফিসার
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড
লালদীঘিরপাড় শাখা, সিলেট