ভাষা, আমাদের ভালোবাসা। ফাল্গুন আসতেই দরজায় একুশের টোকা। একুশে এ এক ব্যতিক্রমী ভোর।
একুশে ফেব্রুয়ারি যখন এলই, তখন গোটা চারেক কথা শুধাই।
বলি, এত দিন কোথায় ছিলেন? হ্যাঁ, আপনি এই যে একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষাকে ছেড়ে এতটা দিন?
সেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে দেখা হয়েছিল। আর মার্চ থেকে জানুয়ারি—১১টা মাস দেখা নেই। কোথায় যে থাকেন এত দিন ভুলে!
কিসের এত ব্যস্ততা আপনার! ভাষার দিকে আর তাকানোর সময় নেই কেন আপনার? এ পর্যন্ত কয়টা একুশ হাতে পেলেন? খুব কম তো নয়। কিন্তু কতটুকু, কতখানি?
চারদিকে এখন চোখে পড়ে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড। ইংরেজিপ্রীতি বলে পথেঘাটে চোখে পড়ে লন্ডন রেস্টুরেন্ট, আমেরিকান রেস্টুরেন্ট নামে কত কী। ইংরেজি নামে কত বাহারি রকমের বিশ্ববিদ্যালয়।
পৃথিবীতে কত ভাষা মরে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে। শোক শব্দটাও বোধ হয় মরতে বসেছে। আবার কয়টা ভাষা তো বড়ও হচ্ছে। প্রশ্ন, বেড়ে উঠবে কবে? হয়ে থাকছে বেঁটে, অপুষ্ট। তাই জুতসই ফুড দরকার। সুতরাং একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষামঞ্চে আজই একটা কর্মসূচি। দেরি নয়, মঞ্চ সাজাতে হবে—শহরের মেয়র হবেন প্রধান অতিথি, কয়েকজন কাউন্সিলর বিশেষ অতিথি। শোনা যায়, তাঁদের অনেক অপকীর্তির কেচ্ছাকাহিনি।
দেখুন মেলে পাঁচ নয়ন। কাকে দেখাবেন? কাকে আবার। যাকে ভালোবাসি তাকে। ভাষাকে। ভাষার সঙ্গে ভূখণ্ডকেও। ওই দেখুন—ফণীমনসার ঝোপে তাদের ছায়া পড়েছে, জাম-বট-কাঁঠাল-হিজলের ছায়া। কেয়াবনের ঝোপে ওই দেখুন জোনাকির মিটিমিটি, আছে নীল সন্ধ্যা এক, মনে হবে কেশবতী কন্যা এক এসেছে ওই নীল আকাশে।
কোথায় গাড়ি আপনার? ওই যে এমবাসির কাছে। আপনার ভাষা? আজ বাংলা। কাল হয়ে যাবে উর্দু, হিন্দি নয়তো ইংরেজি। তাই তো বাড়িঘর রয়েছে কানাডায়। তাদের যতই অনুরোধ করি, তারা বাংলা ভাষায় ফিরে আসবে না। ওরা গাইবে না ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ—আমরা পেয়েছি সোনার বর্ণমালা। নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছে কত বড় বড় সভায়, সে আমাদেরই ভাষা। আজন্ম সহচর। একদিন মুখের ভাত ফেলে মুখের ভাষাকে বাঁচাতে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক ছুটে ছিলেন রণক্ষেত্রে—ঢাকার রাজপথে। তাঁরা বলে গিয়েছিলেন, ‘পান্তাভাত বেড়ে রেখো, কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ হলেই চলবে। ফিরে এসে খাব, না এলে মাগো ভেবো না।’ বরকতের মা ভেজেছিলেন বিন্নি ধানের খই, উড়কি ধানের মুড়কি। কিন্তু বরকতের ওসব চাই না, চাই ভাষা-মাকে। বরকত বলেছিল, ‘ওরা তোমার কোলে শুয়ে, গল্প শুনতে দেবে না। বলো মা, তা কি হয়?’
আমরা কি এর মূল্যায়ন করতে পেরেছি?
বোধ হয় পারিনি। মুর্শিদাবাদে সন্তান ছিলেন বরকত।
তা–ও কেউ স্মরণ করতে পারবেন না বোধ হয় আজ।
বরকতের জন্মস্থান চোখে দেখেছি, বরকতের বাড়িঘরও দেখেছি, গিয়েছি ভাষাশহীদ বরকতের টানে।
অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস পালন করলেও বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ব আজও যেন কমই। ব্যক্তিগতভাবে এক মরমি মানব আমি। এই ৭০ বছর বয়সেও আমার সেই মরমি মন নিয়ে তাকিয়ে থাকি মাতৃভাষা দিবসের দিকে। একুশে ফেব্রুয়ারি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শহীদ মিনারে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে তাকে বরণ করে নিতে হবে, নিতেই হবে।
সেই ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের তরুণেরা প্রাণ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, স্লোগান দিয়ে। সেই দিন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। সারা বিশ্ব এই দিনকে মান্যতা দিয়েছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস রূপে।
বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষের কাছে, সব রকমের ভাষার মানুষের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস।
অবশেষে বলি, মাতৃভাষাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি, প্রাণের ভেতরে রাখি, রাখবই।
লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাকা