দেশে দক্ষ শ্রমিকের অভাব কবে ঘুচবে

কোনো দেশের জাতীয় উন্নয়ন বলতে সেই দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বোঝায়, যা কিনা ওই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান সরকারও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। তবে সব ধরনের উন্নয়ন ব্যর্থ হবে, যদি দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলা না হয়।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ হওয়ার কারণে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি থাকলেও দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক খাতগুলোর ব্যয়কৃত অর্থ সেসব শ্রমিকের অর্জন হিসেবে চলে যায় দেশের বাইরে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) তথ্যমতে, দেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, তবে এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিভিন্ন খাতে মোট ৮ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। এই সময় পর্যন্ত দেশের ৯টি শিল্প খাতে নিয়োগ দিতে হবে আরও ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৪ হাজার নতুন শ্রমিক। এর মধ্যে দক্ষ শ্রমিক লাগবে ৮০ লাখ, আধা দক্ষ ৫৬ লাখ ও অদক্ষ শ্রমিক লাগবে ৩১ লাখ। অন্য এক পরিসংখ্যানমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় মোট রপ্তানি ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া পুঁজিস্বল্পতা ও বাজার সংকোচনের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্প, এসএমই খাত এবং ইনফরমাল খাতে ব্যাপক বেকারত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে দেশের মোট কর্মসংস্থানের ২০ শতাংশ শিল্প খাতকে ঘিরে, তবে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও এখানে দক্ষ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

হিসাবমতে, ২০২৫ সাল নাগাদ ৯টি শিল্প খাতে ৮০ লাখ দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে, বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি জনশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এ বিপুল মানুষের মাধ্যমে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা, তা আসছে না। এর অন্যতম কারণ প্রবাসে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির অভাব। দেশে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ঝোঁক বাড়ছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাঁদের মধ্যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা গড়ে উঠছে না। আর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে, তার সঙ্গে শিল্প খাতের চাহিদার কোনো সামঞ্জস্য নেই।

বাংলাদেশের কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবে সব সময়ই দক্ষ মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। দেশের পোশাক খাতেই করোনা–পরবর্তী সময়ে ৩ লাখ দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন হবে, কিন্তু সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বে শ্রমবাজারে আরও চাপ পড়েছে। ফলে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদাও বেড়েছে। আমরা চাইলেও সে সুযোগ নিতে পারছি না। কারণ, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বেকার তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা অনার্স-মাস্টার্স পাস করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চাকরিও পাচ্ছেন না, আবার দক্ষতার অভাবে কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ভালো করতে পারছেন না।

দেশের প্রধান শিল্প খাতগুলোয় দক্ষ জনবলের সংকট তীব্র হচ্ছে। বর্তমানে ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রপ্তানি আয়ের তৈরি পোশাক খাত। এ সুযোগে কয়েক হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণ করতে হবে। বিভিন্ন শিল্পের কর্মীদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে পারদর্শী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের মানুষকে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

সাহেদা আক্তার
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ

ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী।