‘সেতু পাইয়্যা আমগোর কথা ভুলে যাইয়্যেন না’

কথিত আছে, রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মার ভাঙনের মুখে পড়ে ধ্বংস হয় বলে পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। পদ্মার আগ্রাসী আচরণ এমন কথনকে পোক্ত করার জন্য যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণাবিষয়ক সংস্থা নাসা ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। দুর্বল ও অপরিণত মাটির কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছে মাওয়া, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ। রাজবাড়ী, কুষ্টিয়াসহ পদ্মাবিধৌত অঞ্চলগুলোও নিস্তার পায়নি পদ্মার আগ্রাসন থেকে। অজস্র উত্থান-পতন, আনন্দ-উচ্ছ্বাস কিংবা কান্নার নোনাজল মিশে আছে খরস্রোতা পদ্মায়। কত গল্পের উপসংহার টেনে সূচনা হয়েছে অন্য গল্পের, তার ইয়াত্তা নেই।

পদ্মার করালগ্রাসে ভূমিপুত্ররা কেবল নিঃস্বই হয়নি, প্রমত্তা এ নদীর বুকে খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকার আশ্রয়। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলকে সংযোগকারী প্রধান দুই নৌপথ বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটকে কেন্দ্র করে গত দুই যুগেরও অধিক সময়জুড়ে গড়ে উঠেছে নানা অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। হাজারো নিম্নবিত্ত মানুষের ভাগ্য আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে আছে শতাধিক নৌযানের নোঙরে। হকার শ্রেণির কয়েক শ লোকজন লঞ্চ ও ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেন ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, শনপাপড়ি, তিলের খাজা, ভাত-ইলিশ, শসা, গাজর, পেয়ারা, দইসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার। নৌযানভেদে ৫ থেকে ১০ জন হকার বিচিত্র ভঙ্গিতে আকৃষ্ট করেন যাত্রীদের। লোভনীয় উপস্থাপনায় ভর করে হয় আয়-উপার্জন। ঘাটের পন্টুনে ঘুরে ঘুরেও বিক্রি করেন কেউ কেউ। পদ্মার উভয় পাড়ে স্থায়ী-অস্থায়ী খাবার হোটেলের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতন।

পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে অসংখ্য শিল্পকারখানা। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে কয়েক গুণ গতিতে। আপাতত এসব দূরের কথা। সেতুর ওপরতলার যাত্রী হয়ে নিচে আমাদের পুরোনো সহচরদের ভুলে যেতে পারি না। হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সেতু চালুর আনন্দ ম্লান হতে বসেছে বেকারত্ব কিংবা পেশা বদলের উদ্বেগে।

দৈনিক পদ্মা পাড়ি দেওয়া হাজারো মানুষের কল্যাণে যাঁদের ঘরের চুলায় আগুন জ্বলে, তাঁদের দুঃসময় আসন্ন। কারণটা সহজেয় অনুমেয়। সবকিছু ঠিক থাকলে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানের ক্ষণ আসছে ২৫ জুন। প্রমত্তা পদ্মার বুক ছিঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গৌরব ও অহংকারের প্রতীক হিসেবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১ জেলার মানুষের যাতায়াত হবে ঝঞ্ঝাটহীন, সাশ্রয়ী হবে সময়। পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠবে অসংখ্য শিল্পকারখানা। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে কয়েক গুণ গতিতে। আপাতত এসব দূরের কথা। সেতুর ওপরতলার যাত্রী হয়ে নিচে আমাদের পুরোনো সহচরদের ভুলে যেতে পারি না। হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সেতু চালুর আনন্দ ম্লান হতে বসেছে বেকারত্ব কিংবা পেশা বদলের উদ্বেগে।

বাংলাবাজার ঘাটের হকার টুলু মিয়ার অভিমত হলো, ‘ঘাট না থাকলে তো মামা আমগো ব্যবসা উঠব লাটে। খামু কি! পরমু কি! ব্রিজের ওপরে তো আর ব্যবসা চলব না। সরকার যদি আমগোরে সহজ শর্তে কিছু ঋণ দিত, ওইটা দিয়া নতুন করে কিছু কইরা দু মুঠো খাইতে পারতাম। তই মামা, সেতু পাইয়্যা আমগোর কথা ভুলে যাইয়্যেন না।’
টুলু মিয়াদের ভুলে যাওয়া যাবে না। এরা দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে এই নৌপথের যাত্রীদের সেবা দিয়েছেন। কোনো উন্নয়ন টেকসই করতে হলে এর সুফল সব শ্রেণি–পেশার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো একান্ত আবশ্যক। অসহায়ের বোবা কান্না উপেক্ষা করে দামি জিডিপি ও অসম মাথাপিছু আয়ের ঘোড়দৌড় নিরর্থক।

রহিম শেখ নামের আরেক হকার জানান, ‘আমাদের সামনে বিকল্প পথে আয়ের রাস্তা খুবই কম। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটাই দিছি পদ্মার পাড়ে। এখন কৃষিকাজ কিংবা পদ্মায় মাছ ধরা লাগবে। আমাদের তো অত পয়সা নাই যে সেতুর আশপাশে কাটামু।’

কোভিড মহামারির পর দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মন্দা অবস্থা কাটাতে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ, শিল্প, সেবা ও কৃষি খাত। সরকার অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ঘোষিত প্রণোদনা ও শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানেই আটকে থাকে। জিডিপির সিংহভাগ (প্রায় ৪০ শতাংশ) জোগানদাতা অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে সিকি ভাগও জুটে না। ফলে দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠী ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। চলমান ব্যবস্থার রূপান্তর না ঘটলে সমাজে বৈষম্য ও মেরুকরণ বৃদ্ধি পাবে এবং সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে ওপরতলার কতিপয় মানুষের হাতে, যা হবে যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ।

রাষ্ট্রযন্ত্রের স্টিয়ারিং ঘোরানোতে নৈকট্য ও প্রভাব বেশি বলে গোষ্ঠীতন্ত্রই (অলিগার্কি) নীতিনির্ধারণীতে নিয়ামক হয়ে উঠে। জিডিপির সিংহভাগ জোগানদাতারা হয়ে পড়েন প্রান্তিক। জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের এমন বিমাতাসুলভ আচরণ ত্বরান্বিত করছে শ্রেণি বৈষম্য, অস্থিরতা এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির হার। বিভিন্ন আর্থসামাজিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন পূর্বাভাস দিচ্ছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধির যা দেশের ঝুঁকিপ্রবণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করবে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকে নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়ায় সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। ভেঙে পড়বে সামাজিক সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার বলয়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নিয়মিতই ধেয়ে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগ (সম্প্রতি সিলেটের বন্যা) পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ঠিকে থাকার সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তুলছে। মহামারির আঘাতে চাকরিচ্যুতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানাবিধ সমস্যা বিষিয়ে তুলছে সামগ্রিক জনজীবন।

পদ্মাপাড়–সংলগ্ন ঘাটের হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও হয়তো রাজধানীর কাঁধে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। ছোট-বড় সমস্ত সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকাকেন্দ্রিক করে ৬০ থেকে ৭০ দশকের প্রাণবন্ত ঢাকা এখন মৃতপ্রায়। তার ওপর অদক্ষ নগর ব্যবস্থাপনায় নাজুক শহরটি ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষ সারিতে দখল করে চলেছে। ব্যয়বহুল শহর ঢাকায় মানিয়ে নিতে না পেরে অনেকে পরিবার–পরিজন নিয়ে ছুটছেন গ্রাম ও মফস্বলের দিকে।
মেগা প্রকল্পগুলো বেড়ে ওঠার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাতিলের খাতায় ফেলা যাবে না। তাঁরাও সামগ্রিক উন্নয়নের অংশীদার। উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের পুনর্বাসনকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রণীত নকশায় বড় প্রকল্পগুলো প্রাণ পাবে। কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে সামাজিক বৈষম্য ও মেরুকরণ।

মাহমুদুল হাছান
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)
[email protected]