গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর। তারাকান্দর শুধু একটি গ্রামই নয়, গোপালগঞ্জ তথা দেশের অন্যতম বড় বধ্যভূমি। পুরো গ্রামে একাত্তরে যে নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা, তা কল্পনাকেও হার মানায়। সারা দেশের মতো ১৯৭১ সালে কোটালীপাড়ার একাধিক গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ হলেও এ গ্রামের মতো এত মানুষের আত্মাহুতি দিতে হয়নি কোথাও। এখানে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে এটি দুই শতাধিক বলে মনে করেন। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর (সুবর্ণজয়ন্তী) পার হয়ে গেলেও এ গ্রামে শহীদদের স্মরণে এখনো নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক কিংবা স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৭১ সালের মে মাস, বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের দামামা। কান্দি ইউনিয়ন তথা কোটালীপাড়ার মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেন যুদ্ধের। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁরা তারাকান্দর বালাবাড়ি প্রতিরোধ শিবির গড়ে তোলেন। স্থানীয় লোকের পাশাপাশি কোটালীপাড়ার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আশ্রয় নিতে আসা নারী-পুরুষনির্বিশেষে ওই বাড়িতে তাঁবু খাঁটিয়ে আশ্রয় নেন। এ খবর যায় পার্শ্ববর্তী গোপালপুর-পূর্ণবতী-কুরপালা-কাকডাঙা গ্রামের রাজাকার আলবদরদের কাছে। তারা জানে যে শুধু তারা এসে এ প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে পারবে না। তাই পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন দিন বসে পরিকল্পনা করে তারাকান্দর আক্রমণের।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫১ বছর। জগদীশ বৈদ্যের মতো সেই দিনের সেসব শহীদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এই দিনে তাঁদের স্মরণ করা তো দূরের কথা, তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা মানুষ জানেও না। এমনকি তাঁদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। গোপালগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বই প্রকাশিত হলেও সেখানে তারকান্দর বধ্যভূমির ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি।
কোটালীপাড়া থানা থেকে (১৯ জ্যৈষ্ঠ) মঙ্গলবার সকালে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ জন পাকিস্তানি আর্মি গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পাকিস্তানিদের স্থানীয় দোসর রাজাকার সেখ আহমদ আলী (আহমদ চেয়ারম্যান), আফতাব উদ্দিন (আপ্তু মিয়া), বারেক হাওলাদার (বারেক মাস্টার), আবদুস সোবহান হাওলাদারসহ আরও অনেকে। তাদের ইশারায় পাকিস্তানি বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। গানবোটে করে ঘাঘর নদীতীরবর্তী ঘুঘরাহাটি গ্রামে নেমে একপর্যায়ে ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে। মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহস্র জনতা ভারী অস্ত্রশস্ত্রের গুলি ও শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকের ওখানেই সলিলসমাধি ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হন তাঁরা। প্রাণভয়ে অস্ত্রশস্ত্র রেখে যে যেভাবে পারে প্রাণরক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদরেরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। সহস্রাধিক মানুষ যে যেভাবে পারে আশ্রয় নেয় ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে। সেখানে পালিয়েও বাঁচতে পারেননি তাঁরা। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রাম দা, কুড়াল, কালি দিয়ে শতাধিক আবালবৃদ্ধবনিতাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা। বেলা ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। কেউ কেউ মনে করেন সে সংখ্যাটা দুই শর অধিক হবে। পাকিস্তানি হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার নীরব সাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।
সেই ঘটনার সাক্ষী ও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত জগদীশ বৈদ্য দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর তিন বছর আগে মারা গেছেন যশোরের বসুন্দিয়ায়। সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন জগদীশ বৈদ্য। তখন ছিলেন ৩০ বছরের টগবগে তরুণ। শত্রুর ভারী অস্ত্রের আঘাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কচুরিপানাভর্তি ডোবায়। তার এক হাতে রাম দা অন্য হাতে কালি। মনে মনে প্রতিজ্ঞায় অবিচল। মরার আগে একটা শত্রু হলেও খতম করবেন। কিন্তু তা পারেননি। এর আগেই শত্রুরা তাঁকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি। কিন্তু গুলি যায় মাথার ওপর দিয়ে। একই সঙ্গে কালি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কালির ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে যান জগদীশ বৈদ্য। ভয়াল সেই দিনের কথা কাউকে জানাতে চাননি কখনো। কারণ, পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজাকার, আলবদরেরা তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে শুরু করে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বসুন্দিয়া আশ্রয় নেন। দীর্ঘদিন মানবেতর জীবন যাপন করার পর সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্ত্রী ও ছয় মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই মেয়ে স্থানীয় চাল-ডালের মিলে কাজ করেন। এই মেয়েদের ওপর নির্ভর করেই শেষ জীবনে রোগে শোকে নানা কষ্টে বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর আগের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন; কিন্তু তা পাননি। মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ও স্বীকৃতি না পেয়েই তিনি পরপারে পাড়ি দিয়েছেন।
তারাকান্দর গ্রামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সত্তরোর্ধ্ব নটোবর রায় তাঁদের বাড়ির সামনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি আর্মি রাজকাকারদের তাড়া খেয়ে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাঁদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা। তাঁদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া (সমদ্দার), তাঁর স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁড়িয়া ও তাঁর ছেলে ছিল। এ ছাড়া ছিল দরশন রায়, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনোমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়।’
সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে যেন আঁতকে ওঠেন। তারাকান্দর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এভাবে তারাকান্দর বৈদ্যবাড়ি, রায়বাড়ি, বিশ্বাসবাড়ির দক্ষিণ পাশের মাঠে ও পুকুরপাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। যেসব শহীদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাঁদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তাঁর দুই মেয়ে, পঁচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডলের, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এ ছাড়া নাম না জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা। এভাবে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করতে করতে পশ্চিম তারাকান্দর থেকে পূর্ব তারাকান্দর হয়ে নলভিটা পর্যন্ত যায় পাকিস্তানি বাহিনী।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫১ বছর। জগদীশ বৈদ্যের মতো সেই দিনের সেসব শহীদের কথা কেউ মনে রাখেনি। এই দিনে তাঁদের স্মরণ করা তো দূরের কথা, তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা মানুষ জানেও না। এমনকি তাঁদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। গোপালগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বই প্রকাশিত হলেও সেখানে তারকান্দর বধ্যভূমির ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মানুষের দাবি, এসব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
এলাকাবাসীর সঙ্গে একই সুরে সুর মিলিয়ে সেই ভয়াল ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী, কান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অনিলচন্দ্র রায় বলেন, ‘সেদিনের ভয়াবহ দৃশ্য ভোলার নয়। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। আমাদের দাবি, এখানে শহীদদের ত্যাগের সম্মান ও স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।’
বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলাকার সংসদ সদস্য। অথচ আজ পর্যন্ত গোপালগঞ্জের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমির স্মৃতি সংরক্ষণে কারও তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। তাই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’র মাধ্যমে তারাকান্দর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।
কান্দি ইউনিয়ন তথা কোটালীপাড়ার মানুষ কোনো কিছু হলে তাকিয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলে গেল। আপনার প্রিয় কান্দি ইউনিয়নবাসীর সামান্য দাবি পূরণ হলো না এখনো। রাজাকার-আলবদরদের নির্মম নির্যাতনের যন্ত্রণা শরীরে বহন করে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পেয়েই অনেক মনোবেদনা নিয়ে চলে গেছেন জগদীশ বৈদ্য। এখানে শহীদদের পরিবারের যেসব সদস্য এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের মনোবেদনা দূর করতে এবং ইতিহাসের নির্মম সত্য ও বাস্তবতাকে নতুন প্রজন্মকে জানাতে; জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে সবিনয় অনুরোধ, ১৯৭১ সালে তারাকান্দরের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
প্রশান্ত অধিকারী সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী